ভগৎ সিং-এর সঙ্গী হয়ে পার্লামেন্ট হাউসে বোমাবর্ষণ, বটুকেশ্বর দত্ত-র শেষ জীবন কেটেছে চরম অর্থকষ্টে

দিল্লির এইমস সংলগ্ন এলাকার একটি ঘরে শুয়ে আছেন এক বৃদ্ধ। বয়স তখনও ষাট পেরোয়নি; কিন্তু শরীরের অবস্থা সেই কথা জানান দিচ্ছে না মোটেই। কোনোক্রমে শ্বাসটুকু ধরে রেখেছেন। একটু ভালো ডাক্তারকে দেখাবেন, তেমন অবস্থাও নেই পরিবারে। দারিদ্র্য যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে তাঁকে। কী করবেন তিনি? একেবারে অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকেন পুরনো দিনগুলোর দিকে। এই সেই দিল্লি, যেখানে একদিন এসেছিলেন বিপ্লবীর বেশে। লক্ষ্য ছিল ইংরেজ শাসকদের দমন করা, স্বাধীন ভারতবর্ষের জন্ম। মনে পড়ে বর্ধমানের কথা। একদিন নিজের গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছিলেন বিপ্লবের ব্রত নিয়ে। কিন্তু জীবনের শেষ লগ্নে এসে এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে, ভাবতেই পারেননি বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্ত। সরকারের সাহায্য? সেসব তো অতীত…

বর্ধমানের খণ্ডঘোষ থানার ওয়াড়ি গ্রাম। এখানেই ১৯১০ সালের ১৮ নভেম্বর জন্ম নেন বটুকেশ্বর। প্রাথমিক বেড়ে ওঠাটা শুরু হয়েছিল বাংলার মাটিতেই। বাবার ছিল রেলের চাকরি, কানপুরে নিজের কাজে চলে গিয়েছিলেন তিনি। একটা সময় পর বটুকেশ্বরও সেখানে চলে যান। কানপুরেই চলে তাঁর পড়াশোনা। কিন্তু আগুনের আঁচ তো তখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পথে নামতে শুরু করেছে মানুষ। কেউ বেছে নিচ্ছে কংগ্রেসের অহিংস নীতি, কেউ আবার চরমপন্থী আদর্শ। অনুনয়-বিনয় নয়, ব্রিটিশকে তাড়াতে গেলে বিপ্লবী আন্দোলনই হোক একমাত্র পথ— এমন দাবিই উঠে আসছিল ভারতের কোণায় কোণায়। 

সেই পথেই পা বাড়ান বটুকেশ্বর দত্তও। চন্দ্রশেখর আজাদ তখন সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন নামে নতুন একটি সংগঠন শুরু করেছেন। সেখানেই যোগ দিলেন তিনি। সেখানেই আলাপ আরও এক মানুষের সঙ্গে। জালিয়ানওয়ালাবাগের মাটি থেকে উঠে এসেছেন তিনি। কথা বলে বটুকেশ্বরের মনে হল, দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজেকে সমর্পিত করেছেন মানুষটি। বাড়ি থেকে বিয়েশাদির ব্যাপারে জোর করায় পাঞ্জাব থেকে পালিয়ে কানপুরে চলে এসেছেন। নাম, ভগৎ সিং। সেই থেকে শুরু দুজনের বন্ধুত্বের। একসঙ্গে দীক্ষা নেওয়া বিপ্লবী মতাদর্শে। সেইসঙ্গে গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থীর পত্রিকা ‘প্রতাপ’-এর সঙ্গেও যুক্ত হন দুজনে। শুরু হয় আন্দোলনের প্রস্তুতি। 

১৯২৮ সাল। সাইমন কমিশনকে নিয়ে বিদ্রোহের রেশ তখনও জারি আছে। এমন সময় প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করেন লালা লাজপত রায়। মিছিলের একদম সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন তিনি। হঠাৎই সেখানে চড়াও হয় পুলিশ বাহিনি। মিছিলের ওপর অবিশ্রান্ত লাঠিবর্ষণ করতে থাকে তাঁরা। বৃদ্ধ লালা লাজপত রায় সেই আঘাত নিতে পারেননি। লাঠির ঘায়ে গুরুতর আহত হন; পরে মারাও যান। পাঞ্জাবের এমন এক নেতার মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি কেউ। অনেক হয়েছে ব্রিটিশদের রাজত্ব, আর সহ্য করা চলবে না। ঠিক হল, সাহেবদের সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিতে হবে। প্রথমে পুলিশ সুপার জেমস স্কট-কে মারার পরিকল্পনা করলেন ভগৎ সিং-রা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সেই জায়গায় মারা যান সহকারী সুপার জন স্যান্ডার্স। যাই হোক, একটা ভুলে আন্দোলন থামিয়ে রাখা যাবে না। তার আগে ধরপাকড় শুরু হলে বটুকেশ্বর দত্ত পালিয়ে যান বর্ধমানে। বহুদিন পর আবার নিজের মাটিতে পা রাখা। কিন্তু ঘরে লুকিয়ে থাকলে তো চলবে না! প্রতিবেশীর বাড়ির নিচে এক গোপন সুড়ঙ্গে আত্মগোপন করেন তিনি। শোনা যায়, ভগৎ সিংও তাঁর সঙ্গে এখানে এসেছিলেন। এরপরই দুই বন্ধু চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেন… 

৮ এপ্রিল, ১৯২৯। দিল্লির পার্লামেন্ট হাউসে পাবলিক সেফটি ও ট্রেড ডিসপুট বিল পাশ হওয়ার কথা ছিল এইদিন। সবার সঙ্গে সংসদ কক্ষে উপস্থিত ছিলেন আরও দুই ব্যক্তি। পরিচয় গোপন করে ঢুকেছিলেন তাঁরা। দর্শকাসনে চুপচাপ বসেছিলেন, সুযোগের অপেক্ষা করছিলেন। হাতে রয়েছে তাজা দুটো বোমা। হঠাৎই বিকট আওয়াজে কেঁপে উঠল ঘর। ধোঁয়ায় ভর্তি হয়ে গেল, কয়েকজন আহতও হলেন। আর সেই ধোঁয়ার ভেতর থেকে গর্জে উঠল দুটো আওয়াজ— ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ!’ ছদ্মবেশ ভেদ করে স্পষ্ট হল ভগৎ সিং আর বটুকেশ্বর দত্তের মুখ। পালানোর বিন্দুমাত্রও চেষ্টা করলেন না দুজনে। বরং ক্রমশ গর্জে উঠছে তাঁদের গলা। একসময় এগিয়ে এল সশস্ত্র পুলিশ। গ্রেফতার করা হল দুজনকে।

এরপর ভগৎ সিংয়ের ফাঁসির বর্ণনা তো সবারই জানা। তাঁর জীবন নিয়ে আস্ত সিনেমাও হয়ে গেছে। আর বটুকেশ্বর দত্ত? তাঁর বিপক্ষে খুব বেশি প্রমাণ জোগাড় করতে পারেনি পুলিশ। তাই মৃত্যুদণ্ড হয়নি; আন্দামানের সেলুলার জেলে বন্দি করা হয় তাঁকে। সেই সময় সেলুলার জেল ছিল বিভীষিকা। যেসব বিপ্লবীদের পাঠানো হত, তাঁদের ওপর চলত অকথ্য অত্যাচার। অনেকে সেই অত্যাচারের ফলেই মারা যেতেন, নয়তো অসুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসতেন। বটুকেশ্বর দত্তও প্রবল অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন থেকেই বোধহয় ভেতরে বাসা বাঁধে টিবি রোগ। মুক্তি পাওয়ার পর দেশে ফিরে এলেও, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় আবার গ্রেফতার হন তিনি। না, আর কোনোদিনও বর্ধমানের মাটিতে ফিরতে পারেননি… 

আরও পড়ুন
‘হিন্দু-বিরোধী’ অভিযোগে বাদ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম; শহিদ-তালিকা ঘিরে বিক্ষোভ

একসময় নিজের চোখের সামনেই দেখলেন ভারতের স্বাধীনতা। এতদিনে স্বপ্নপূরণ! যার জন্য এত সংগ্রাম, এত ত্যাগ স্বীকার, অবশেষে তা সম্পন্ন হল। পাটনায় ফিরে গিয়ে বিয়েও করলেন বটুকেশ্বর দত্ত। তখনও কি জানতেন নিজের পরবর্তী জীবনের কথা? স্বাধীন সরকার তাঁকে স্বাধীনতা সংগ্রামীর কার্ড দিয়েছে। হিসেবমতো তাঁর সমস্ত সম্মানই পাওয়া উচিত। সেসব কিছুই হয়নি। ভগৎ সিংকে মানুষ মনে রেখেছে ঠিকই, কিন্তু তাঁর সঙ্গীকে ভুলে গেছে। বেঁচে থাকাকালীনই এমন দিন দেখে যেতে হয়েছিল বটুকেশ্বর দত্তকে। পরিবারের অবস্থা একদম ভালো ছিল না। বাধ্য হয়ে পরিবহণের ব্যবসায় যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। কাজের জায়গায় মানুষটিকে কেউ কখনও চিনতে পেরেছিলেন কি? জানা যায় না। 

আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না তাঁর। ধীরে ধীরে শরীরও যেন সরে যেতে লাগল। চিকিৎসা করাবেন কী করে! টাকাই তো নেই! প্রায় নিঃস্ব মানুষটা পরিবার নিয়ে ফিরে আসেন দিল্লিতে। সেই দিল্লি! চেয়েছিলেন, মৃত্যুর পর তাঁর দেহ যেন পাঞ্জাবের হুসেইনিওয়ালায় দাহ করা হয়। সেখানেই যে বন্ধু ও সহযোগী ভগৎ সিংয়ের দেহও ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল! বর্ধমানের ওয়াড়ি গ্রাম বটুকেশ্বর দত্তের সমস্ত স্মৃতি বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু তিনি নিজেই হারিয়ে গেলেন চিরতরের জন্য। ১৯৬৫ সাল। মাত্র ৫৪ বছর বয়সে, অভাবের বোঝা কাঁধে নিয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ভারত ও বাংলার অন্যতম বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্ত… 

তথ্যসূত্র- 

আরও পড়ুন
স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে বিশেষ অধ্যায় থাকুক পাঠ্যপুস্তকে, দাবি ক্ষুদিরামের আত্মীয়ের

১) ‘অর্থের অভাব, নিজের চিকিৎসার টাকা জোগাতে সমস্যায় পড়েছিলেন বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্ত’, ইটিভি ভারত
২) ‘এই সুড়ঙ্গেই লুকিয়ে ছিলেন ভগৎ সিং ও বর্ধমানের ভূমিপুত্র বটুকেশ্বর দত্ত’, কলকাতা ২৪X৭
৩) ‘বর্ধমান এবার বটুকেশ্বর?’, ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী, আনন্দবাজার পত্রিকা
৪) ‘স্বাধীন ভারতে সম্মানটুকু জোটেনি, বর্ধমানের গর্ব বটুকেশ্বরকে ফেরালেন মোদী’, জি নিউজ 

Powered by Froala Editor

More From Author See More