আমফানে ভেসেছে আশ্রয়; মাধ্যমিকের সাফল্যে নতুন স্বপ্ন বুনছে সুন্দরবনের রাজা

দিন দুয়েক আগে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ থেকে প্রকাশিত হয়েছে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল। মাধ্যমিক মানে লক্ষাধিক পরীক্ষার্থীর জীবনের প্রথম বড়ো পরীক্ষা। স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে যেখানে মুখোমুখি সামিল হয় সারা রাজ্যের পরীক্ষার্থী। আর তাই লকডাউনের মধ্যেও এই ফলাফলকে ঘিরে এখন পাড়ায় পাড়ায় চলছে আলোচনা। কেউ রেজাল্ট পেয়ে আনন্দিত, কারোর মনের মধ্যে হতাশা। ঠিক এই সময় সুন্দরবনের পাথরপ্রতিমা ব্লকের সুরেন্দ্রনগর গ্রামে মুখ লুকিয়ে খানিকটা চোখের জল আড়াল করার চেষ্টা করছে রাজা রায়।

না, পরীক্ষার ফল তার আশানুরূপ হয়নি। আশা করেছিল অন্তত স্টার নম্বর পাবে। কিন্তু মার্কশিট হাতে পেয়ে দেখল, ৭০০-র মধ্যে ৪৫০ পেয়েছে রাজা। ফার্স্ট ডিভিশন তো বটেই। কিন্তু এই সংখ্যার হিসাবে তার সাফল্যের মূল্যায়ন করলে হয়তো খানিকটা ভুল হবে। কারণ জীবনে অন্য এক লড়াইয়ে ক্রমাগত যুদ্ধ করে যেতে হয় রাজাকে। যে জীবন এখনও দেশের অনেক মানুষের কাছেই এক নির্মম বাস্তবতা।

এই তো কয়েক মাস আগের কথা, আমফান ঝড়ের দাপটে প্রায় ভেসে গিয়েছিল সুন্দরবন। মাথার উপরের ছাদটুকু হারিয়েছিলেন বহু মানুষ। সেইসব মানুষের মধ্যেই ছিল রাজার পরিবার। তিন ভাই ও দুই বোনকে আগেই সরকারি ছাউনিতে পাঠিয়ে দিয়েছিল রাজা। কিন্তু নিজে মাকে নিয়ে থেকে গিয়েছিল ঘর আঁকড়ে। যদি কোনোভাবে বাঁচানো যায়।

তবে শেষ পর্যন্ত কোনোকিছুই বাঁচাতে পারেনি রাজা। প্রহরকে জানাল সেই অভিজ্ঞতার কথা। "ঝড় আসার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের দেওয়ালগুলো কাঁপতে শুরু করেছিল। তারপর একসময় ছ্যাতরার ঘরের মাথার উপর অ্যাডবেস্টারের ছাদটাও উড়ে গেল। বুঝলাম আর কিছু করার নেই। কিন্তু হেঁটে গিয়ে যে পাশের পাকাবাড়িতে আশ্রয় নেব, সেটুকু ক্ষমতাও তখন ছিল না।" ১৭ বছরের রাজাকে এভাবেই লড়াই করতে হয়েছে তার জীবনের সঙ্গে। এর আগেও ফনি এবং বুলবুলের দাপটের কথা তার মনে আছে। তখন অবশ্য তাদের আশ্রয় হারায়নি। কিন্তু এলাকার সমস্ত ফসল ভেসে গিয়েছিল। আর এসবের মধ্যেই কোনরকমে পড়াশুনো চালিয়ে গিয়েছে রাজা।

আরও পড়ুন
পরীক্ষা আসছে, পরীক্ষা যাচ্ছে; ‘শিক্ষিত’ হচ্ছি কি?

পশ্চিম সুরেন্দ্রনগর আদর্শ বিদ্যাপীঠের ছাত্র রাজা রায় ছোট থেকেই মেধাবী বলে পরিচিত। স্কুলেও বরাবর প্রথম হয়ে এসেছে সে। আর তাই একটু একটু করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল সে। হয়তো ভাগ্য সেই অধিকারই দেয়নি তাকে। রাজাকে এবং তার তিন ভাই ও দুই বোনকে ছেড়ে যখন তার বাবা চলে গিয়েছিল, তখন থেকেই তো লড়াই শুরু। সংসারকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই। অতটুকু বয়সে এইসব দায়িত্ব নেওয়ার কথা হয়তো অনেকেই ভাবতে পারবেন না। রাজার পরের যে ভাই, সংসারের চাপে সেও পড়াশুনো ছেড়ে দিয়েছে। এখন সে ওড়িশায় পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করে। লকডাউনের সময় তার অবস্থাও শোচনীয়। কিন্তু লড়াই যে এখনও পিছু ছাড়েনি।

মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই বেশ কিছুদিন ধরে সুরেন্দ্রনগর এলাকায় হাজির হত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রছাত্রী। এডুকেশন ফর অল নামের একটি মঞ্চের মাধ্যমে তারা সমস্ত পড়ুয়ার সমান অধিকারের বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করত। তাদের দেখেই রাজা স্বপ্ন বুঝেছিল একদিন সেও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। তারপর অঙ্ক নিয়ে পড়াশুনো করে সে শিক্ষক হবে। যাদবপুরের এক ছাত্র, সৌম্য ঘোরই জানালেন, "এর মধ্যেও যখন আমফান বিধ্বস্ত এলাকায় আমরা ত্রাণ নিয়ে হাজির হলাম, তখন রাজা প্রায় একাই সব ব্যবস্থা সামলেছে। গ্রামে ঘুরে ঘুরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের লিস্ট তৈরি করেছে।" অদ্ভুত এক মানসিক জোর যেন তাকে লড়াইতে টিকিয়ে রেখেছে।

আরও পড়ুন
৩০ বছর পর ফেরা পড়াশোনায়, ঠাকুমার উচ্চ-মাধ্যমিক পাশের খবরে উচ্ছ্বসিত নাতনিরাও

কলকাতায় এসে পড়াশুনো করার কথা ভাবতেও এখন ভয় লাগে তার। এর মধ্যে বাড়ির সঞ্চয়ও সব শেষ। লকডাউনের পরেও যেটুকু বেঁচে ছিল, সেটাও নিয়ে গিয়েছে আমফান। একটু বেশি রোজগারের জন্য রাতেও পাওয়ার টিলার চালাচ্ছে রাজা। বেঁচে থাকতে গেলে সবার আগে প্রয়োজন খাবার। সেটুকুও সংস্থানই যাদের নেই, উচ্চশিক্ষার বিলাসিতা কি তাদের সত্যিই মানায়? উত্তর দিতে হবে আমাদের এই বৈষম্য-জর্জরিত সমাজকেই।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
উচ্চমাধ্যমিকের পর, এবার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের পরীক্ষাও স্থগিত রাজ্যে

Latest News See More