তরুণ মজুমদারকে উৎসর্গীকৃত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, সাক্ষী থাকল কলকাতা

“আজকাল পাড়ায় পাড়ায় ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল আয়োজিত হয়। তবে লক্ষ করলে বোঝা যাবে, তার মধ্যেও একটা প্রতারণা আছে। চেনা-পরিচিতদের পুরস্কার বিতরণ, তাদের ছবি সিলেক্ট করা— আরও অনেক কিছু। পরিচালক, চলচ্চিত্র জগতের মানুষরা যাতে ন্যায্য বিচার পান সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই পথ চলা শুরু করেছিলাম…”

বলছিলেন পরিচালক কৌশিক রায় পাউ (Kaushik Roy Pau)। কৌশিকবাবুর আরও একটি পরিচয়ও আছে। ‘হট্টমেলা’ (Hottomela) সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা এবং কার্য পরিচালক তিনি। বছর চারেক আগে তাঁর উদ্যোগেই কলকাতার বুকে শুরু হল একটি নতুন চলচ্চিত্র উৎসব। ‘হট্টমেলা’-র ব্যানারেই। স্বজনপোষণ, রাজনৈতিক পক্ষপাতের জটিল অঙ্কের জাল ছিঁড়ে সুষ্ঠুভাবে এক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনই ছিল কৌশিকবাবুর প্রধান লক্ষ্য। তাঁর এই উদ্যোগকে বাঁকা চোখে দেখেছিলেন অনেকেই, তীর্যক প্রশ্নবাণও ভেসে আসত অহরহ। তবে হাল ছাড়েননি তিনি। কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবকে একত্রিত করেই আয়োজিত করেছিলেন এই চলচ্চিত্র উৎসব। সম্প্রতি চার বছর পা দিল এই ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। 

গত ২৭ নভেম্বর, কলকাতার মহাবোধি সোসাইটিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘হট্টমেলা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’-এর ‘চতুর্থ পর্ব’। জন্মলগ্নে দুই বাংলার ছবির ওপরেই মূলত ফোকাস করেছিলেন কৌশিক। তারপর ধীরে ধীরে পরিধি বেড়েছে এই চলচ্চিত্র উৎসবের। পশ্চিমবঙ্গের সীমানা পেরিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ছবি তো বটেই, এখন বিদেশ থেকেও নিয়মিত ছবি জমা পড়ে এই চলচ্চিত্র উৎসবে। চলতি বছরেই দেখানো হয়েছিল ভারত, বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, ফিনল্যান্ড, ইরান, তুরস্ক, মিশর-সহ ১২টি দেশের ছবি। যার মধ্যে যেমন রয়েছে তথ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি, তেমনই রয়েছে অ্যানিমেশন, পোয়েট্রি ফিল্ম, পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র ইত্যাদি। বিশেষ অতিথি হিসাবে হাজির ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক বীরেশ চট্টোপাধ্যায়, রাজা মিত্র, শিল্প নির্দেশক, চিত্রকর ও ভাস্কর সমীর কুণ্ডুর মতো মানুষরাও। 


গত বছর পরিচালক তপন সিংহ-কে উৎসর্গ করে আয়োজিত হয় ‘হট্টমেলা’। সেই ধারা বজায় থাকল চলতি বছরেও। এ-বছর এই চলচ্চিত্র উৎসব উৎসর্গ করা পরিচালক তরুণ মজুমদারকে। “প্রত্যেকটা শংসাপত্র, স্মারকেই মজুমদারের ছবি রাখা হয়েছিল। দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে ওঁকে পৌঁছে দেওয়াই লক্ষ্য ছিল। তাছাড়া ওঁর ওপর একটি স্মৃতিচিত্রও দেখানো হয়েছিল আমাদের চলচ্চিত্র উৎসবে”, জানালেন কৌশিক। ‘চিরতরুণ বৃক্ষ’-খ্যাত এই স্মৃতিচিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন এই চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্যোক্তা নিজেই। তথ্যচিত্র নয়, বরং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া তরুণ মজুমদারের সাক্ষাৎকার এবং তাঁর সিনেমার চিত্রপটের কোলাজ বলা চলে এই স্মৃতিচিত্রকে। 

বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্রের স্ক্রিনিং-এর সঙ্গেই চলতি বছরে ‘হট্টমেলা’-র মঞ্চে উন্মোচিত হয়েছে কৌশিক রায় পাউ-এর ছবি ভিড়ভ্রান্তি-র পোস্টার-ও। মুক্তি পেয়েছে বার্তাবহ কৌতুক ছবিটির ট্রেলার-ও। মুকুল মাইতির ছোটোগল্প ‘ছাতা’ অবলম্বনে তৈরি এই চলচ্চিত্রটির শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে বর্তমানে, জানালেন পরিচালক।

কথায় কথায় জানা গেল, এই চলচ্চিত্র উৎসবে পাঠানো চলচ্চিত্র সিলেক্টেড না হলে, সাবমিশন ফি ফিরিয়ে দেওয়া হয় পরিচালককে। কৌশিকের কথায়, “বহু জায়গায় এভাবে ঠকেছি। বহু চলচ্চিত্র উৎসবে পরিচালকের থেকে সিনেমা চেয়ে যে টাকা নেওয়া হলেও পরবর্তীতে নিম্ন মানের ছবি দেখানো হয়। সাবমিশন ফি-টা নেওয়া হয় উৎসব আয়োজনের জন্যই।” এই ‘দুর্নীতি’-র বিরুদ্ধেই তাঁর সওয়াল এই চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন। তাছাড়া সাউন্ড মাস্টারিং থেকে শুরু করে পোস্টার ডিজাইন, টেকনিশিয়ান— প্রতিটি বিভাগেই পুরস্কার দেওয়া হয় হট্টমেলায়। কেবলমাত্র পরিচালকরাই একমাত্র মধ্যমণি নন এই চলচ্চিত্র উৎসবের। লক্ষ্য, চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সমস্ত শিল্পীকেই অনুপ্রেরণা প্রদান করা। আগামী বছরে পঞ্চম বর্ষে পা দেবে হট্টমেলা। তা নিয়ে যথেষ্ট উৎসাহিতও কৌশিক। আরও বড়ো করে, বিশেষ চমক নিয়ে হাজির হবে আন্তর্জাতিক এই চলচ্চিত্র উৎসব, জানিয়ে রাখলেন তরুণ যোদ্ধা… 

Powered by Froala Editor

More From Author See More