এ-বছরের সেরা মহিলা ফুটবলার, শিকড় লুকিয়ে কলকাতায়!

ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো বা লিও মেসিকে ছাপিয়ে গোটা বছর-জুড়ে ধারাবাহিক ফর্ম বজায় রেখেছিলেন ফ্রেঞ্চ ও রিয়্যাল মাদ্রিদ তারকা করিম বেঞ্জিমা। সেই সুবাদে বিশ্বকাপ শুরুর মাস কয়েক আগেই, ২০২২-এর ‘ফুটবলার অফ দ্য ইয়ার’ খেতাবও ওঠে তাঁর মুকুটে। তবে এই স্বীকৃতির ভাগীদার একমাত্র তিনিই নন। তার সঙ্গে এই একই খেতাব পান এক অস্ট্রেলিয়ান তারকাও। স্যাম কের। মহিলা বিভাগে চেলসির এই স্ট্রাইকারই এবছরের সেরা ফুটবলার। 

তবে এই প্রথম কোনো বড়ো পুরস্কার নয়। ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার (Australia) সেরা ফুটবল খেলোয়াড়ের খেতাব জিতেছিলেন স্যাম। আর তারপরই এক আশ্চর্য ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল গোটা বিশ্ব। “আমি ভারতীয় বংশোদ্ভূত হওয়ায় গর্বিত”, পুরস্কার নেওয়ার সময় অকুণ্ঠভাবে এ-কথা উচ্চারণ করেছিলেন স্যাম কের (Sam Kerr)! হ্যাঁ, শুনতে একটু অবাক লাগাই স্বাভাবিক। তবে এ-দেশের সঙ্গে নিবিড় যোগ রয়েছে ২৯ বছর বয়সি অস্ট্রেলিয়ার তারকার। আরও বিশেষভাবে বলতে গেলে তিনি এই মহানগরেরই (Kolkata) উত্তরসূরি। 

এই গল্পের শুরু প্রায় একশো বছরেরও বেশি সময় আগে। সেটা বিশ শতকের শুরুর দিক। ব্রিটেন থেকে কলকাতায় এসে বসতি গেড়েছিল কের পরিবার। ১৯১২ সালে কলকাতার মাটিতেই জন্ম স্যামের ঠাকুর্দা ড্যানজিল মাওব্রে কের-এর। তৎকালীন সময়ে কলকাতা তথা বাংলার ফেদারওয়েট বক্সারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ড্যানজিল। অন্যদিকে ঠাকুমা কোরাল বেরিল ছিলেন খেলতেন বাস্কেটবল। 

ধমনীতে বাঙালি রক্ত প্রবাহিত না হলেও, একরকম বাঙালিই হয়ে উঠেছিলেন ড্যানজিল কিংবা কোরাল। বঙ্গভূমিকেই করে নিয়েছিলেন নিজের দেশ। দেশ স্বাধীনের পরও তাই ভারত ছেড়ে ব্রিটেনে ফিরে যেতে চাননি কেউ-ই। এমনকি কলকাতার মাটিতেই জন্ম হয়েছিল স্যামের বাবা রজারের। মজার বিষয় হল, তিনিও জড়িত ছিলেন ক্রীড়াজগতে, ফুটবলের সঙ্গেই। কের পরিবারের এই বঙ্গপ্রীতির প্রমাণ পাওয়া যায় স্যামের নামেও। বাংলা তথা ভারতীয় সংস্কৃতি মেনেই কোরাল নাতনির নাম রেখেছিলেন ‘সামন্তা’। ফুটবলের ময়দানে যা হয়ে গেছে ‘স্যাম’।

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে ধীরে ধীরে কলকাতা তথা গোটা বাংলা থেকে অবলুপ্ত হতে শুরু করে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব। অর্থনৈতিক সংকট ছাড়াও একাধিক কারণ ছিল তার পিছনে। সে যাই হোক না কেন, বহু অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারের মতোই সত্তরের দশকের শেষ দিকেই কলকাতা ছাড়েন কের-রা। তবে ইংল্যান্ড নয়, একাধিক দেশ ঘুরে শেষ অবধি অস্ট্রেলিয়ায় থিতু হন ড্যানজিল। কেননা, ততদিনে ভারতের পরিবেশ ও জলহাওয়াতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। 

তবে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে নতুন করে বসতি স্থাপন করা সহজ ছিল না খুব একটা। প্রথমত সঞ্চয় ফুরিয়ে এসেছে ততদিনে। তার ওপর গায়ের রং। চার প্রজন্ম ধরে ভারতে বসবাস করায়, ততদিন আর ‘শ্বেতাঙ্গ’ নন তিনি। ফলে, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশেও বর্ণবাদের শিকার হতে হয়েছিল কের পরিবারকে। এমনকি নাগরিকত্ব পেতেও লড়াই করতে হয়েছে বিস্তর। 

অস্ট্রেলিয়ায় বাবার কোচিং-এই ফুটবল খেলা শুরু স্যাম কের-এর। ১৩ বছর বয়সেই সুযোগ জুড়ে যায় অস্ট্রেলিয়ার সকার ক্লাব ‘পার্থ গ্লোরি’-তে। তারপর জাতীয় দল। বিশ্বকাপের মঞ্চে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কত্বও করেছেন স্যাম। বর্তমানে একাধিক প্রথম সারির অস্ট্রেলিয়ান দলে খেলে থিতু হয়েছেন ইপিএল ক্লাব চেলসিতে। তাদের হয়েই খেলেই বর্ষসেরা ফুটবলারের খেতাব-জয়। ফাইনালে পৌঁছে যাওয়া উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের।  

স্যামের সাফল্যের পরিসংখ্যান না হয় পরে দেওয়া যাবে কখনও। ভারতীয় যোগ নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, তখন স্যামের ঠাকুমার কথাও বলে রাখা যাক বরং। বিদেশে জন্ম ও বড়ো হয়ে ওঠা হলেও, ঠাকুমাকে আজও ‘গ্র্যানি’-র বদলে ‘নানি’ বলেই ডাকেন অস্ট্রেলিয়ান সুপারস্টার। এমনকি ঠাকুমা কোরাল মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন তাঁর নাতনি ফুটবলের বিশ্বমঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করছেন ভারতের। 

চলতি বছরেই ভারতে আয়োজিত হয়েছিল উইমেনস এশিয়ান কাপ। সেখানে অংশ নিতে এসেছিলেন স্যাম। সর্বোচ্চ গোল করে পিতৃপুরুষের ‘আদি-ভিটে’-তে রেকর্ডও করেছেন তিনি। সে-সময় আরও একবার তাঁর মুখে শোনা গিয়েছিল ভারত বন্দনার কথা। গর্ব করেই জানান, চেহারায় ভারতীয় ছাপই তাঁর আসল পরিচয়। 

কলকাতাকে ভারতের ফুটবল-রাজধানী বললেও ভুল হয় না এতটুকু। এ-শহরের মতো ফুটবল উন্মাদনা ভারত তো বটেই, বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তেও খুব কমই চোখে পড়ে। ডার্বির দিনে উপচে ওঠে ফুটবল স্টেডিয়াম। তবে তা সত্ত্বেও আজও ব্রাত্য মহিলা ফুটবলাররা। ইস্ট-মোহন থেকে কোনো মহিলা তারকা উঠে আসবেন ভারতের জাতীয় মহিলা ফুটবল দলে, এখনও তা স্বপ্নের মতোই। তবে তরুণ মহিলা তারকার যে অভাব রয়েছে এ-রাজ্যে, এমনটা নয়। অভাব পরিকাঠামোর। সামন্তার সাফল্য যেন নিশ্চুপে পাশে এসে দাঁড়ায় সেইসব তরুণীদের। যথাযথ সুযোগ-সুবিধা পেলে, কলকাতা থেকেও উঠে আসতে পারে বিশ্বমানের মহিলা ফুটবলাররা— এ-আশাও করতেই পারি আমরা!

Powered by Froala Editor

More From Author See More