‘শতাব্দীর বৃহত্তম ডাকাতি’! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোষাগার থেকে চুরি কোটি টাকার সোনা?

মহামারী চলছে তখন। বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিল নেটফ্লিক্সের ওয়েবসিরিজ ‘মানি হাইস্ট’। জাতীয় ব্যাঙ্কের সবচেয়ে সুরক্ষিত ভল্ট থেকে হাজার হাজার টন সোনা গলিয়ে পাচার করার আশ্চর্য কৌশল অবাক করে দিয়েছিল গোটা দুনিয়াকে। কিন্তু বাস্তব দুনিয়ায় যদি এমন ঘটনা ঘটে?

১৯০৫ সাল। বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিল এমনই একটি সংবাদ। একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় বড়ো বড়ো করে ছাপা হয়েছিল ‘শতাব্দীর সবচেয়ে বড়ো ডাকাতি’-র (Heist Of The Century) কাহিনি। সাধারণ কোনো ব্যাঙ্ক নয়, খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজকোষ (US Treasury) থেকেই রাতারাতি ২৭ কোটি মার্কিন ডলারের সোনা হাপিশ করেছে ডাকাতরা। আর এই ডাকাতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন সে-দেশেরই ধনকুবেররা। ডাকাতদের অর্থ ও অন্যান্য তথ্য দিয়ে তাঁরাই নাকি সাহায্য করেছেন এই কর্মকাণ্ডে।

না, কোনো আমেরিকান পত্রিকা নয়, এই সংবাদ প্রথম প্রকাশিত হয় জার্মান পত্রিকা ‘বার্লিনার ট্র্যাজব্লাট’-এ। সেইসঙ্গে এও জানানো হয়, গোটা বিষয়টিকে ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে মার্কিন প্রশাসন। তবে এই খবর প্রকাশ্যে এল কীভাবে? নেপথ্যে ‘বার্লিনার ট্যাজব্লাট’-এর নিউ ইয়র্ক করেসপন্ডেন্ট এল. ট্রিয়াং। জার্মান হলেও সাংবাদিকতার কাজে নিউ ইয়র্কেই জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেছেন ট্রিয়াং। এই প্রতিবেদন প্রকাশের আগে বেশ কিছু সরকারি কেচ্ছা-কারছুপিও প্রকাশ্যে এনেছিলেন তিনি। কাজেই এমন এক সাংবাদিকের প্রতিবেদন যে গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দেবে, তাতে আর সন্দেহ কী?

প্রশ্ন থেকে যায়, কীভাবে হয়েছিল ‘ইউএস ট্রেসারি হাইস্ট’-খ্যাত এই চুরি? ট্রিয়াং-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ১৯০২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ব্যাঙ্ক অফ পটোম্যাক’-এর ঠিক গা ঘেঁষেই তৈরি হয়েছিল একটি বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরির কারখানা। সেই কারখানার মধ্যেই এই ঐতিহাসিক ডাকাতির প্রস্তুতি। কারখানা থেকেই কাটা হয়েছিল বেশ কয়েকটি টানেল। যার গভীরতা ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩০ ফুট। একদিকে যেমন এই টানেল সংযুক্ত করত ‘মায়ারস, মিড অ্যান্ড কোং’ কারখানা এবং যুক্তরাষ্ট্রের কোষাগারকে, তেমনই এই সুড়ঙ্গের অন্যপ্রান্তটি উন্মুক্ত ছিল সমুদ্রে। এই সুড়ঙ্গ তৈরির পরই ১৯০৫ সালে বন্ধ হয়ে যায় কারখানাটি। 

এই টানেলের মধ্যে দিয়েই বৈদ্যুতিক শক্তিচালিত সাবমেরিনে চেপে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারির নিচে হাজির হয় ডাকাতরা। তারপর মাটি খুঁড়ে ঢুকে পড়ে কোষাগারের ১৩টি ভল্টের একটিতে। শুধুমাত্র সোনা এবং রুপোর বিস্কুট সংরক্ষিত ছিল সেখানে। রবারের ব্যাগে ভরে, সেগুলি দ্রুত পাঠিয়ে দেওয়া বন্দরে। চারটি পৃথক পৃথক জাহাজে করে সেই ধনরত্ন ‘পাড়ি’ দেয় পৃথিবীর চারপ্রান্তে। 

শুধু আমেরিকান ধনকুবেররাই নয়, অভিযোগ উঠেছিল কলোম্বিয়া এবং মেক্সিকোর দিকেও। বাদ যাননি ইউরোপিয়ানরাও। ইউরোপীয়দের তৈরি সাবমেরিনে চেপেই নাকি এই দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়েছিলেন মেক্সিকান এবং কলোম্বিয়ান পাইরেটরা। 

জার্মান ট্যাবলেটটিতে এই আশ্চর্য রহস্যময় সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পরই, একে একে তা ছাপা হতে শুরু করে অস্ট্রিয়া, ইতালি, বেলজিয়াম, পোল্যান্ড-সহ অন্যান্য দেশের পত্রপত্রিকাতেও। তবে মজার বিষয় হল, এই ঘটনা নিয়ে একবারের জন্য কোনো শব্দ উচ্চারিত হয়নি কোনো মার্কিন সংবাদমাধ্যমে। এমনকি এত বড়ো ডাকাতির পরেও বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়েনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজারেও। কারণ, নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর সে-দেশের মানুষদের অগাধ বিশ্বাস। বৈদ্যুতিক অ্যালার্ম এবং প্রহরী বেষ্টিত এই ভল্ট চুরি করা অসম্ভব বলেই, বিশ্বাস ছিল তাঁদের। 

এই বিশ্বাস কতটা ঠিক বা ভুল, তা জানা নেই। তবে দেশের কোষাগার থেকে যে এক পয়সাও চুরি যায়নি, সে ব্যাপারে একশো শতাংশই সঠিক ছিলেন তাঁরা। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে পরদিন। ‘বার্লিনার ট্র্যাজব্লাট’-এ জানানো হয়, এই চুরির কাহিনি আসলে সম্পূর্ণ একটি হোক্স। পয়লা এপ্রিল, বিশ্ববাসীকে এপ্রিল ফুল করতেই এমন গল্প সাজিয়েছিলেন তাঁদের নিউ ইয়র্ক করেসপন্ডেন্ট। গোটা বিষয়টিই ছিল নিখাদ রসিকতা। তবে এই গল্প যে সবটা ট্রিয়াং-এর মস্তিষ্কপ্রসূত, এমনটাও নয়। অ্যালফ্রেড হেনরি লুইসের ‘দ্য প্রেসিডেন্ট’-শীর্ষক উপন্যাস থেকেই এই দৃশ্যপট তুলে ধরেছিলেন ট্রিয়াং। সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলেন কিছু বাস্তব সত্যও। যেমন, পটোম্যাক ব্যাঙ্কের পাশে অবস্থিত পরিত্যক্ত কারখানাটির অস্তিত্ব। 

মজার বিষয় হল, যেদিন ‘বার্লিনার ট্র্যাজব্লাট’ এই রস-রহস্য উন্মোচন করে, সেদিন বহু আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রেই ছাপা হয়ে গিয়েছিল টানেলের ছায়া-ছায়া ছবি, কিংবা ভাঙা ভল্টের চিত্র। যা সবটাই ছিল মনগড়া কিংবা কৃত্রিমভাবে বানানো ছবি। যা প্রকাশ্যে আনে সংবাদ দুনিয়ার এক অন্ধকার দিককেও। জনপ্রিয় খবর ছাপার দৌড়ে অনেকক্ষেত্রে তথ্য যাচাই-এর রাস্তায় হাঁটে না খ্যাতনামা সংবাদমাধ্যমও— তা ফুটে ওঠে এই ঘটনায়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করা হল, এই ঘটনার জেরে যদি অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘনিয়ে আসত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, রাতারাতি ধ্বসে পড়ত শেয়ার বাজার, তাহলেও কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চুপ করে বসে থাকত? কে বলতে পারে, এমনটা হলে হয়তো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই ঘটে যেতে পারত আরও একটি ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ…

Powered by Froala Editor

More From Author See More