আরও কড়া ছিল নিয়ম! কীভাবে বিবর্তিত হল অফসাইড?

স্টেডিয়ামের ছাদের বিভিন্ন কোণে লাগানো রয়েছে ১২টি ক্যামেরা। এই ক্যামেরাই বলে দেবে খেলোয়াড়দের গতিবিধি, কোন মুহূর্তে তাদের অবস্থান ঠিক কোথায়। সেমিঅটোমেটেড অফসাইড টেকনোলজি। চলতি বিশ্বকাপেই এই বিশেষ প্রযুক্তিটির ব্যবহার শুরু করেছে ফিফা (FIFA)। আর ইতিমধ্যেই তা রীতিমতো ভাগ্য বদলে দিয়েছে বেশ কিছু হাই-ভোল্টেজ ম্যাচের। যার মধ্যে আর্জেন্টিনা-সৌদি আরবের ম্যাচটি অন্যতম। অফসাইডের (Offside) জন্যই বাতিল হয়ে যায় আর্জেন্টিনার তিন তিনটি গোল। 

গোল বাতিল হওয়ার জন্য অভিযোগ তুলেছেন বহু সমর্থক। কেউ কেউ আবার বলছেন এই বিশেষ প্রযুক্তির ব্যবহারে গোল করাই কঠিন হয়ে উঠেছে আরও। তবে মজার বিষয় হল, একটা সময় আজকের থেকেও কঠিন ছিল অফসাইডের নিয়ম। সেই গল্পই বলা যাক বরং। 

আজ থেকে দেড়শো বছর আগের কথা। ১৮৬৩ সালের ২৬ অক্টোবর। ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত হয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। এই সংস্থা তৈরির মাস দুয়েক পরই প্রকাশ পায় বিশ্বের প্রথম ‘অফিসিয়াল ফুটবল রুলবুক’। ’৬৩-এর ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত সেই নথিতেই প্রথমবারের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ‘অফসাইড’-কে ফুটবলের অঙ্গ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। আর তার পিছনে যথেষ্ট কারণও ছিল। 

সে-সময় স্ট্রাইকাররা সাধারণত বিপক্ষের পেনাল্টি বক্স বা গোলের সামনে ঘোরাঘুরি করতেন সুযোগের অপেক্ষায়। বল আসলেই যাতে দ্রুত ঠেলে দেওয়া যায় তে-কাঠির মধ্যে। তৎকালীন সময়ে ফুটবলের ভাষায় এটিকে বলা হত ‘গোল হ্যাংগিং’। তাতে একদিকে যেমন প্রচুর গোল হত এক একটি ম্যাচে, তেমনই নষ্ট হত ফুটবলের নান্দনিকতাও। মাঠ জুড়ে খেলা নয়, বরং দুই গোলের সামনে তৈরি হল খেলোয়াড়দের জটলা। এই সমস্যার সমাধানেই অফসাইডের নিয়ম প্রবর্তন করে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। 

তখনকার নিয়ম ছিল, মাঝমাঠের উপরে খেলা হলে, বল পাশ করার মুহূর্তে কোনো খেলোয়াড় বলের থেকে এগিয়ে থাকলেই, তাঁর অবস্থানকে অফসাইড হিসাবে গণ্য করা হবে। ১৮৬৩ সালে ‘মর্লে’স বার্নস’ এবং ‘রিচমন্ড’— এই দুই দলের মধ্যে খেলায় প্রথমবারের জন্য আরোপিত হয়েছিল এই নিয়ম। 

তবে এই ম্যাচের আগে যে অফসাইড ছিল না, এমনটা নয় একেবারেই। আঠারো শতকের শেষের দিক থেকেই স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের বহু খেলায় থাকত অফসাইডের নিয়ম। তবে ক্ষেত্র ও স্থান বিশেষে সেই নিয়মও বদলে যেত। বদলে যেত রেফারির নিজস্ব ধারণা ভিত্তিতেও। ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের রুল বুক মেনেই ইতি পড়ে সেই যুগের।

তবে বছর তিনেকের মধ্যেই এই নতুন আইনটিও বদলানো হয়ে ওঠে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারণ, এই নিয়মের দৌলতে সে-সময় অধিকাংশ ম্যাচই শেষ হত ০-০ গোলে। ১৯৬৬ সালে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন প্রথমবারের জন্য সংশোধন আনে ‘অফসাইড আইন’-এ। খানিকটা নমনীয় করা হয় অফসাইডের নিয়ম। জানানো হয়, বিপক্ষের তিন জনের কম খেলোয়াড় কোনো খেলোয়াড়ের থেকে এগিয়ে থাকলে, অফসাইড ঘোষণা করা হবে তাঁর অবস্থানকে। ব্যাপারটা কেমন? ধরুন, বক্সের মধ্যে গোলকিপার ছাড়াও হাজির এক ডিফেন্ডার। রয়েছেন আপনিও। এমন সময় ভেসে আসা বল রিসিভ করলেই অফসাইড হবেন আপনি। তবে বিপক্ষের গোলরক্ষক ছাড়াও যদি দু’জন রক্ষণভাগের খেলোয়াড় হাজির থাকে, তবে আইনত হিসাবে ধরা হবে আপনার অবস্থানকে। 

তবে এই নিয়মেও যে সম্পূর্ণভাবে সমাধান মিলেছিল এমনটা নয়। পাশাপাশি ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তাও বেড়েছিল ফুটবলের। বাড়তে থাকে মাঠে খেলা দেখতে আসা দর্শকদের ভিড়ও। ম্যাচের স্কোর লাইন দেখে হামেশাই হতাশ হতেন তাঁরা। সেই কারণেই ফের প্রয়োজন পরে নতুন নিয়ম প্রবর্তনের। 

১৯২৫ সালে ফের অফসাইডের নিয়ম পরিবর্তন করে ফিফা। তিন থেকে বিপক্ষের খেলোয়াড়ের সংখ্যা কমিয়ে করা হয় দুই। অর্থাৎ, গোলকিপার-সহ আরও এক বিপক্ষের ডিফেন্ডারকে এগিয়ে থাকতে হবে কোনো খেলোয়াড়ের থেকে, তবেই বাঁচা যাবে অফসাইড থেকে। এই নিয়মই বিশ্ব ফুটবলে জারি ছিল সবচেয়ে বেশি সময় ধরে, ১৯২৮-এর অলিম্পিক থেকে ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপের আগে পর্যন্ত। 

১৯৯০ সালে বিশ্বকাপের ঠিক আগেই ফের বদলে যায় অফসাইডের নিয়ম। আজকের সময়ে যে নিয়ম মেনে অফসাইড ঘোষণা করা হয়, ’৯০-এর সংশোধনে চালু হয়েছিল সেই নিয়মটিই। এবার কাতারে সেই নিয়মে আক্ষরিক অর্থে বদল হয়নি কিছুই। তবে প্রযুক্তির দৌলতে তা হয়ে উঠেছে আরও ক্ষুরধার। বল বাড়ানোর মুহূর্তে, বিপক্ষের শেষ ডিফেন্ডারের থেকে শরীরের কোনো অংশ এগিয়ে থাকলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ঘোষণা করা হচ্ছে অফসাইড। তাতে বহু গোল বাতিল হলেও, গোল যে একেবারে হচ্ছে না— এমনটা নয়। পাশাপাশি এ-কথাও অস্বীকার করার জায়গা নেই, মানব-রেফারির সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্কের অবকাশও কমেছে অনেকাংশেই… 

Powered by Froala Editor

More From Author See More