৭২ বছর বয়সেও প্রতিদিন ট্রেকিং! নজির মহারাষ্ট্রের অনুসূয়ার

পায়ে একজোড়া চপ্পল। হাতে ধরা লাঠি। এই নিয়েই মাথায় ভারি বোঝা চাপিয়ে খাড়াই পর্বতে চড়ছেন এক বৃদ্ধা। মহারাষ্ট্রের হরিশচন্দ্রগড় (Harishchandragad) পাহাড়ে গেলে প্রতিদিনই দেখা যাবে এই দৃশ্য। ৭২ বছর বয়সি এক প্রবীণার এমন ট্রেকিং দক্ষতা রীতিমতো বিস্ময়করই বটে। 

অনুসূয়া বাঈ (Anusua Bai)। জন্ম মহারাষ্ট্রের কোথালে। ছোটো থেকেই দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করেই বড়ো হয়ে ওঠা। বিবাহের পরও অব্যাহত থাকে এই লড়াই। দৈনিক মজুরির কৃষি শ্রমিক হিসাবেই দীর্ঘদিন কাজ করতেন অনুসূয়া এবং তাঁর স্বামী নাথু। ১২ ঘণ্টা হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বদলে মিলত মাত্র ৪০-৫০ টাকা। কখনও খাবার জুটত, কখনও আবার সন্তানদের মুখে দানা তুলে জল খেয়েই ঘুমাতে হত তাঁদের। এই আর্থিক সংকটের জেরে সকলে ভাঙে পরিবার। এমনকি ধীরে ধীরে কাজের খোঁজে শহরে পাড়ি দিয়েছে কোথাল সংলগ্ন নারায়নগাঁও-এর প্রায় সকলেই। তবে কোনোদিনই ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে চাননি নাথু কিংবা অনুসূয়া। 

দেড় দশক আগে তাই পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন ট্রেকিংকেই। শুনতে একটু অবাক লাগে বৈকি! ট্রেকিং কখনও পেশা হতে পারে? হ্যাঁ, একটু অন্যভাবে। আসলে পর্যটনশিল্পই যে ভাগ্য খুলে দিতে পারে যে-কারোর, একটা সময় পর তা ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন অনুসূয়া। আর সেই বিষয়টিতেই তাই বিনিয়োগ শুরু করেন তিনি। নিকটবর্তী হরিশচন্দ্রগড় পাহাড়ের চুড়োয় বানিয়ে ফেলেন ছোট্ট একটি কুঁড়ে ঘর। সেখানেই ট্রেকারদের জন্য নিয়মিত রান্না হয় খাবার। বিশ্রাম নেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে তাদের জন্য। 

তাতে আয় মন্দ হয় না মোটেই। ৪৭১০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত হরিশচন্দ্রগড় দুর্গ চিরকালই আকর্ষণ করেছে ট্রেকারদের। প্রতি বছর বর্ষা অতিক্রান্ত হলেই পশ্চিমঘাট পর্বতের এই শিখরে ভিড় জমান হাজার হাজার পর্যটক এবং ট্রেকিং-প্রেমী। দিন কয়েকের জন্য তার ভরণপোষণ, গাইডিং এবং সেবা-শুশ্রূষার দায়িত্ব তুলে নেন অনুসূয়া এবং তাঁর পরিবার। স্থানীয় ট্রেকিং কমিউনিটি তো বটেই, বাইরের রাজ্যের ট্রেকারদের কাছেও রীতিমতো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন তিনি। 

তবে সমস্যা একটাই। প্রায় ৫ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই দুর্গম পর্বত শিখরে রাত কাটানোর মতো স্থায়ী ব্যবস্থা নেই কোনো। তার অন্যতম কারণ হল বিদ্যুতের অভাব। পাশাপাশি দুর্গম অঞ্চলে জনবসতি না থাকায়, প্রতিদিনই সমতল থেকে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য সম্পদ বয়ে নিয়ে যেতে হয় পাহাড়-চূড়াতে। আর সেই কাজটাই অক্লান্তভাবে করে চলেছেন অনুসূয়া। প্রতিদিন ভারি বোঝা মাথায় নিয়েই, ৩ কিলোমিটার খাড়াই পথ পাড়ি দিতে হয় তাঁকে। সে-পথ যেমন বৃষ্টির কাদায় পিচ্ছিল, তেমনই কোথাও কোথাও তার কৌণিক অবস্থান সমতলের থেকে ৬০ ডিগ্রি। কাজেই নতুন করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, এই পথ কতটা বিপজ্জনক। তবে এই রাস্তা তরুণ ট্রেকারদের ক্লান্ত করে দিলেও, বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই প্রতিদিন দু’বার করে ট্রেকিং করে চলেছেন মহারাষ্ট্রের বৃদ্ধা। এমনকি অনেকে তাঁকে বুট জুতো কিনে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেও, তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন সেই প্রস্তাব। জানিয়েছেন, লাঠি ও হাওয়াই চপ্পলেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তিনি। তবে শুধু হরিশচন্দ্রগড় দুর্গই নয়, মহারাষ্ট্রের প্রবীণ ট্রেকারের ইচ্ছে, জীবদ্দশায় অন্ততপক্ষে একবার পশ্চিমঘাট পর্বতমালার উচ্চতম শৃঙ্গ কার্ডামম হিলসেও পাড়ি দেবেন তিনি। এ-কথা চোখ বুজিয়েই বলা যায়, সময়-সুযোগ এলে অনায়াসেই সেই চ্যালেঞ্জ উতরে যেতে পারবেন অনুসূয়া…

Powered by Froala Editor