‘যমদুয়ারো দিয়া কাঁটা
ভাই হইল বেফৈ গুটা’
এখনো চোখ বুজলেই মনে পড়ে সেই স্বর ও উচ্চারণ। অথচ তার মালকিন চলে গেছেন বেশ কয়েকবছর হল। যদি বিপরীত-ফোঁটা হত, যদি আমিই এই মন্ত্র বলে ফোঁটা দিতাম তাঁকে, তাহলে কি যমকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে থেকে যেতেন আরও কিছুদিন? নাকি এসব আচার-মন্ত্র সবই নেহাত চোখে ধুলো দেওয়া, মৃত্যু সত্যি-সত্যি এলে ঠেকাতে পারে না কেউই?
পরবর্তীকালে যতবারই আচ্ছন্ন হয়েছে স্মৃতি, মনে পড়েছে ভাইফোঁটার মন্ত্রের ওই নির্দিষ্ট রূপটি। এদিকে আর-সব জায়গায় তো গতানুগতিক চার লাইনই—‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা/যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা/যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা/আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা’। শৈশব থেকে প্রথম যৌবন পর্যন্ত নিজের বাড়িতে শোনা ওই মন্ত্র-রূপটি কি তাহলে ব্যতিক্রম, নেহাতই মুখে-মুখে গড়ে তোলা মাত্র?
এমন এক ধারণা নিয়ে কাটানো দিনকালে কানে এল আরেক মন্ত্র। সামনে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে, কিন্তু মন সেই গণ্ডি মানছে না কিছুতেই। প্রবীণাটি বলে চলেছেন—‘শিলের বাড়ি তুলের বাড়ি/ভাই না যাইয়ো যমের বাড়ি...’। বিস্ময় বাঁধ মানছে না। জিজ্ঞেস করে জানলাম, ময়মনসিংহ সদর থেকে ওই মন্ত্র-উত্তরাধিকার এপার বাংলায় নিয়ে এসেছেন সেই প্রবীণা। আগেই জানতাম, প্রথমোক্ত রূপটি কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর অঞ্চলের। তাহলে কি আমার ধারণা ভুল ছিল? একই মন্ত্র একেক জায়গায় একেকরকম, নিজস্ব বৈশিষ্ট্য শরীরে জড়িয়ে ভাইদের দীর্ঘায়ুকামনা করে চলেছে বছরের পর বছর ধরে?
আরও পড়ুন
মেয়েদের ব্রতপালনের চিরন্তন ধারাই প্রতিফলিত ভাইফোঁটায়
অনুসন্ধানের সেই শুরু। ধীরে ধীরে যা চেহারা নিল এক আস্ত বইয়ের।
আরও পড়ুন
বীরভূমের 'গো-পরব' যেন না-মানুষদের ভাইফোঁটা
ঘাড় ফিরিয়ে সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে, আজও রোমাঞ্চ জাগে। প্রাথমিক বিস্ময় কেটে গেছে ততদিনে। এটুকু জেনেছি যে, একেক জায়গায় ভাইফোঁটার মন্ত্র একেকরকম। এমনকি, একই জায়গাতেও প্রচলিত একাধিক রূপ। কখনো সামান্য শব্দের অদলবদল, কখনো আবার বদলে গেছে পুরো মন্ত্রটাই। কামনায় অবশ্য হেরফের নেই। ‘যমের কবল থেকে দূরত্বে থাকুক ভাই’— অনাদিকাল থেকে চলে-আসা এই চাওয়াই ফুটে উঠেছে প্রত্যেক মন্ত্রে।
ভাইফোঁটার মন্ত্রেরও যে এত রূপভেদ রয়েছে, এই কাজে না নামলে জানাই হত না। অনুসন্ধান যথেষ্ট শ্রমসাপেক্ষ, কেন-না বৃহত্তর প্রেক্ষিতে জাঁকিয়ে বসেছে সর্বাধিক প্রচলিত ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা’-ই। আজ নয়, ১৮৩৬ সালে প্রকাশিত এক ইংরাজি বইয়েও বাংলা হরফ হদিশ দিচ্ছে সেই মন্ত্রেরই। ফলে, এ নিতান্ত অর্বাচীন নয়। এর রাজকীয় উপস্থিতির আড়ালে থাকা আঞ্চলিক রূপগুলিকে খুঁজে পাওয়া খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার মতোই। এদিকে, পশ্চিমবঙ্গে এ-মন্ত্রের রূপভেদ খুব বেশি নেই। কোথাও ‘ভাই যেন হয় লোহার ভাটা’, কোথাও ‘ভাই যেন হয় চিরজীবী’ ইত্যাদি। কমবেশি দু-তিনটি রূপই প্রচলিত আদি-পশ্চিমবঙ্গবাসীর মধ্যে। কোথাও-কোথাও অবশ্য সম্পূর্ণ সংস্কৃতেরি ভাইফোঁটার মন্ত্রটি উচ্চারিত হয়, যদিও তা বিরলই বলা চলে।
তাহলে? এখানেই আকর হয়ে দাঁড়িয়ে পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ)। দেশভাগ-পরবর্তী সময়ে, সে-দেশ থেকে যাঁরা এপারে চলে এসেছেন, অন্যান্য অনেক সংস্কৃতির সঙ্গে বহন করে এনেছেন ভাইফোঁটার নিজস্ব মন্ত্রটিও। প্রথম প্রজন্ম থেকে তৃতীয় প্রজন্ম পর্যন্ত উত্তরাধিকার-সূত্রে আজও অনেক পরিবারে প্রচলিত রয়েছে ওপার বাংলার সেই আঞ্চলিক রূপটিই। সংকলনের কাজে মূল সাহায্য পেয়েছি তাঁদের থেকেই। প্রচুর মানুষের সঙ্গে কথোপকথন, বিষয় ও ভাব আদানপ্রদান। অজস্র মিলের মধ্যে থেকে সামান্য-কিছু অমিল চিহ্নিত করা ও সংকলনে অন্তর্ভুক্তি। বেশ-কিছু রূপ আবার উদ্ধার করেছি বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে। ফলে, দু-বাংলার যৌথ উদ্যোগেই সম্পূর্ণতা পেয়েছে এই কাজ।
তবে, এর মধ্যেও কিছু বিশেষত্ব আছে বইকি! পূর্ববঙ্গ থেকে এসে যাঁরা পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হলেন, তাঁদের দৈনন্দিনতা আছন্ন হল পশ্চিমবঙ্গীয় চলনে, সেই ছাপ পড়ল ভাইফোঁটার মন্ত্রেও। ফলে, অনেকক্ষেত্রেই ওপারের ডায়লেক্টের সঙ্গে মিশে গেল কলকাতার প্রমিত উচ্চারণ। দুইয়ে মিলে, নতুন এক চেহারা নিল সে-মন্ত্র। এগুলিকেই-বা অস্বীকার করি কী করে! যে মন্ত্র লৌকিক, যার প্রচলনই মুখে-মুখে, সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে হাজারো বিক্রিয়ায় তার রূপ যে পরিবর্তিত হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এভাবেই, বিভিন্ন স্রোত এসে মিশেছে ভাইফোঁটার মন্ত্রে, আর ভাইয়ের মঙ্গলকামনা হয়ে উঠেছে বাঙালির অন্যতম কৃত্য।
একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে প্রচলিত মন্ত্রে দেখতে পাই, দিদি ভাইকে বলছেন, ‘বাঘের মুখ থেইক্যা ফিরা আইয়ো’। এ এক আশ্চর্য ইতিহাসের ইঙ্গিত দেয়। যে অঞ্চলে তাঁরা অবস্থান করতেন, হয়তো একসময় তা ব্যাঘ্রসঙ্কুল ছিল। ফলে, যমের পাশাপাশি বাঘের হাত থেকেও যেন ভাই রক্ষা পায়, ভাইফোঁটার মন্ত্রে সেই প্রার্থনা জানাচ্ছেন দিদি। আবার কোথাও দেখি, ‘তাল খাইয়া তাল রইয়ো/তালের তলে দি আইয়ো-যাইয়ো’। সেই অঞ্চলে তালের ফলন ও প্রাচুর্যের হদিশ পাই মন্ত্রে। প্রচ্ছন্নে তালজ্ঞান ঠিক রাখার ইঙ্গিত। কেউ বলছেন ভাই শতবর্ষী হোক, কেউ আবার চান, মার্কণ্ডেয়-লক্ষেশ্বরের মতো হোক ভাই। লৌকিক মন্ত্রের মধ্যেও পুরাণের ইঙ্গিত। অবশ্য যম-যমীর আখ্যানই যেখানে ঋগ্বেদ হয়ে পুরাণে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, সেখানে প্রাসঙ্গিক অন্যান্য চরিত্রও যে হাজির হবে, বলাই বাহুল্য।
চট্টগ্রামের ভাইফোঁটার মন্ত্র সম্পূর্ণভাবে স্থানীয় উচ্চারণের ওপর নির্ভরশীল। ‘ভাইয়র কোয়ালত ডিজ্যি ফোনড্ডা/যমর দুআরত ফোর্গে ক্ষেন্ডা।’ কোথাও কার্তিকের শুক্লাদ্বিতীয়াতে ফোঁটা দেওয়ার বিধান, কোথাও আবার প্রতিপদেই। মন্ত্রের মধ্যে লুকিয়ে আছে এ-নির্দেশও। আছে বিভিন্ন তেতো স্বাদের খাদ্যদ্রব্য—গুফৈ, নাইল্লা আলি, নিম ইত্যাদির সঙ্গে ভাইয়ের তুলনা, যাতে যমেরও অরুচি হয় সে। কোথাও মুখে-মুখে ‘আজ অবধি’ বদলে গেছে ‘আযুবতি’তে। শব্দবিভ্রাটের ফলেই, ভাইয়ের ওপর আরোপিত হয়েছে নারীত্ব। অপূর্ব এক কাব্যিকতা তৈরি হয়েছে সে-মন্ত্রে।
আর এভাবেই, একটি আচারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন এলাকার মন্ত্র ও তার রূপভেদ ছড়িয়ে আছে বাংলার কোণে-কোণে। সেগুলির ভেতরে উঁকি দিলে উঠে আসে অজস্র ঘটনা, ইঙ্গিত ও কামনার তালিকা। গ্রামবাংলার নারীরা মুখে-মুখে মন্ত্রের যে রূপ দিয়েছিলেন একদিন, সেসব সংকলিত করার পর একসঙ্গে পড়ে মনে হয়, এই সহজতা ও সৌন্দর্য ছিল বলেই শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়েও ভাইফোঁটা আজও অমলিন হয়ে থেকে গেছে সমাজজীবনে। অন্যান্য অনেক লোকাচারের মতো দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়নি তার। এর জন্য ধন্যবাদার্হ নারীরাই। তাঁদের প্রণাম!
তথ্যঋণ- না যাইয়ো যমের দুয়ার (ভ্রাতৃদ্বিতীয়া-বিষয়ক প্রথম বাঙ্গালা গ্রন্থ), তন্ময় ভট্টাচার্য, তবুও প্রয়াস প্রকাশনী, ২০২১
চিত্রঋণ- নৃত্যলাল দত্ত, দত্ত প্রেস
Powered by Froala Editor