৬১ বছরে টানা পাঁচ দিন দৌড়ের রেকর্ড! শক্তি জুগিয়েছিল কৈশোরের স্মৃতি

১৯৮৩ সাল। অস্ট্রেলিয়ায় (Australia) প্রথমবারের মতো আয়োজিত হতে চলেছে ‘আলট্রাম্যারাথন’ (Ultramarathon)। সিডনি থেকে দৌড়োতে হবে মেলবোর্ন পর্যন্ত। প্রায় ৮৭৫ কিলোমিটার পথের ধাক্কা! ছয় দিন তো লাগবেই। সেই ভাবেই তৈরি হয়েছেন প্রতিযোগীরা। রেসের দিন ভোর থেকেই দৌড়োনোর বিশেষ পোশাক পরে হাজির হচ্ছেন তাঁরা। অধিকাংশই যুবক, শারীরিকভাবে চূড়ান্ত ‘ফিট’। তাঁদের পিছনে যে এক ৬১ বছরের বৃদ্ধও দাঁড়িয়েছিলেন, প্রথমে খেয়াল করেননি কেউই। হয়তো দর্শক হবে কোনো। পরনে ছেঁড়া-ফাটা ঢলঢলে ট্রাউজার, ফিনফিনে একটা জার্সি আর অত্যন্ত সাদামাটা এক জোড়া বুট। ইনিও দৌড়োবেন নাকি? বিস্ময়ের সঙ্গে খানিক মশকরাও উড়ে এসেছিল দর্শকদের থেকে। কিন্তু দৌড় শুরুর পরের ঘটনা মনে করতে বাধ্য করবে খরগোশ আর কচ্ছপের সেই পুরনো গল্পটাকে। 

বৃদ্ধের পুরো নাম অ্যালবার্ট এর্নেস্ট ক্লিফোর্ড ইয়ং। বড়ো নাম হলে যা হয়, সবাই ছোটো করে ক্লিফ ইয়ং (Cliff Young) বলেই চিনত তাঁকে। বাড়ি দক্ষিণ-পশ্চিম ভিক্টোরিয়া প্রদেশের বিচ অরণ্যভূমির এক গ্রামাঞ্চলে। প্রায় ২০০০ একর জমির মালিক ছিল তাঁর বাবা, ছিল প্রায় সমসংখ্যক ভেড়া। এত জমি হলে কী হবে, লাভের গুড়ে বালি থাকত বছরের বেশির ভাগ সময়। সামর্থ্য ছিল না লোক ভাড়া করার। ফলে ছোট্ট ক্লিফ ইয়ং-এর উপরেই বর্তাল ভেড়ার পাল দেখভালের দায়িত্ব। এমনিতে তারা আপনমনে ঘুরে বেড়ায় জমিতে, কিন্তু ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলেই মাঠে নামতে হয় ক্লিফকে। এক-একটা ভেড়া তো হারিয়ে যেত দূর-দূরান্তে। গামবুট পায়ে দিয়ে ক্লিফ চলল তাদের খুঁজতে। ফেরার পথে দৌড়োতে হত টানা দু-তিন দিন। আলট্রাম্যারাথনের দিন কি সেই স্মৃতিই তাঁকে ছুটিয়ে নিয়ে গেছিল এতটা পথ?

কিছু বছর পর নিজেই শুরু করলেন আলুর চাষ। বিয়ে করলেন না, মা আর ভাইকে নিয়ে কাটতে লাগল সাদামাটা জীবন। ১৯৭৯ সালে হঠাৎ কী একটা ‘ভূত’ চাপল মাথায়। যে বয়সে সবাই অবসর নেয়, সেই বয়সে তিনি ঠিক করলেন দৌড় প্রতিযোগিতায় নামবেন। মেলবোর্নের একটা রেসে নাম দিয়ে এক ঘণ্টায় শেষ করলেন ১৬ কিলোমিটার পথ। প্রাইজ পেলেন না ঠিকই, কিন্তু একটা আকাঙ্ক্ষা চুপ করে বসে রইল মনের মধ্যে। এরপর অংশগ্রহণ করলেন মেলবোর্ন ম্যারাথনেও। নিযুক্ত করলেন একজন পেশাদার প্রশিক্ষক। অবশেষে এল ১৯৮৩ সাল। 

ঢিমেতালেই শুরু হল দৌড়। খানিকক্ষণের মধ্যেই পিছিয়ে পড়লেন সবার থেকে। রাত হল, সকলেই নির্দিষ্টস্থানে উপস্থিত হল বিশ্রামের জন্য। প্রথম দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন ক্লিফও। কিন্তু একটা চালাকি করলেন প্রশিক্ষক মহাশয়। রাত দুটোয় দিয়ে রাখলেন অ্যালার্মের ঘণ্টা। ভোর হয়েছে ভেবে রাতের আঁধারে ঘুম চোখেই আবার শুরু করলেন দৌড়োনো। তারপর আর ঘুমোননি ক্লিফ। সেদিনই পিছনে ফেলে দিয়েছিলেন বাকিদের। টানা পাঁচ দিন না ঘুমিয়েই পৌঁছোলেন মেলবোর্নের স্বপ্নের ঠিকানায়। আর সকলে পৌঁছোলো প্রায় এক দিন পরে। হতবাক সবাই। কী করে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুললেন এই বৃদ্ধ? গল্পের ছলেই নিজের ছোটোবেলার কথা বললেন তিনি। সেই গামবুট পায়ে দিয়ে দু-তিন দিন ধরে ভেড়ার পাল নিয়ে ছুটে বেড়ানোর কাহিনি। সেই অভ্যাস তো ত্যাগ করেননি কোনোদিন। সাফল্য তো লুকিয়ে সেখানেই।

আরও পড়ুন
খালি গায়ে দৌড়ে বেড়ান পথে-পথে, কেনিয়ার রহস্যময় নাইট রানারদের গল্প

জয়ী প্রতিযোগীর জন্য তখনকার সময়ে পুরস্কারমূল্য ছিল ১০০০০ ডলার। ক্লিফ তো নাম দিয়েছিলেন শুধু দৌড়োনোর জন্য, টাকার কথা কিছুই জানতেন না। কী করবেন এত টাকা নিয়ে? অন্য যে ছয় জন রেস শেষ করতে পেরেছিলেন, সকলের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন সেই অর্থ। শুধু হিসেব করে দেখলেন কটা আলু পাওয়া যায় এই টাকায়। আলট্রাম্যারাথন জেতার পরেও ক্লিফ আরো কয়েকটি প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছিলেন। জিততে পারেননি অবশ্য। ১৯৮৪-তে একবার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন সারা অস্ট্রেলিয়া দৌড়োনোর। শেষে দলের এক সদস্য গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় পিছু হটতে হয়। 

আরও পড়ুন
১০৫ বছরে দৌড়ে জাতীয় রেকর্ড

অবসর কোনোদিন নেননি ক্লিফ। ২০০৩ সালে ঘাতক ক্যানসারের হাতে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত দৌড়ে গেছেন। সিনেমা হয়েছে তাঁর গল্প নিয়ে। জীবনও তো অবিরাম দৌড়ে চলা। কেউ পৌঁছোয় সঠিক গন্তব্যে, কেউ-বা হাল ছেড়ে দেয় মাঝপথে। অনেকে ছুটে চলেন নিজের লক্ষ্যে, নিজের স্বাধীনতায়। প্রতিযোগিতার লোভনীয় পুরস্কার না থাকলেও, থেমে যাওয়ার তো উপায় নেই। সেই খরগোশ আর কচ্ছপের গল্পের মতো—‘স্লো অ্যান্ড স্টেডি, অলওয়েজ উইনস দ্য রেস’। বয়স? সে তো একটা সংখ্যামাত্র!

Powered by Froala Editor