বাল্যকাল। সময়টা নিয়ে ধাঁধা যেন লেগেই থাকে। ঠিক কোন সময়টাকে বাল্যকাল বলা হবে, সেই সংজ্ঞায় পরিষ্কার জানানো হয়েছে শূন্য থেকে আঠেরো বছর বয়স অবধি সকলকেই রাখতে হবে এই ব্র্যাকেটে। বাল্যবিবাহের মতো সমস্যা আটকাতে, বর্তমানে ভারতীয় আইন মোতাবেক মেয়েদের ১৮ বছর এবং ছেলেদের ২১ বছরের আগে বিয়ে হওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। বিয়ের পরেও গর্ভবতী হওয়ার ক্ষেত্রে মেয়েদের সচেতন করতে আইন না থাকলেও, শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে স্লোগানই করা হয়েছে, আঠেরোর আগে বিয়ে নয়, একুশের আগে মা নয়।
তবুও এত প্রচার, টিভিতে কাগজে লিফলেটে বিজ্ঞাপনের পরেও কি বদলাচ্ছে ছবিটা সেভাবে? নাকি প্রদীপের নিচে অন্ধকার থাকলেও হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে জ্বলে উঠছে কেউ? বিহারের ১৫ বছরের চাঁদনীর বাবা-মায়ের বিয়ে হয়েছিল শৈশবকালে। গ্রামেগঞ্জে তো হয়েই থাকে এরকমটা। সেই হিসেবে বাবা-মায়ের সাত সন্তানের মধ্যে সবথেকে বড় হিসেবে চাঁদনীরও বিয়ের সময় যেন এসেই গিয়েছিল। বিহারের সমস্তিপুর এলাকার দামোদরপুর মাহালির মতো প্রান্তিক গ্রামে বাল্যবিবাহ এবং শিশু শ্রমিকের মতো ঘটনা চোখে লাগে না কারুরই। চূড়ান্ত দারিদ্র; অশিক্ষা। পুত্র সন্তানের মধ্যে দিয়ে সংসারে অর্থের যোগানদারের জন্ম দিতে বেড়েই চলে ছেলে-মেয়ের সংখ্যাও।
কিন্তু চাঁদনী চায়নি এই চেনা স্রোতে গা ভাসাতে। অসম্ভব দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে পথ চললেও কম বয়সে বিয়েতে গররাজি ছিল সে। বয়ঃসন্ধিকালের বিভিন্ন বিপদ এবং সমস্যাকে কেন্দ্র করে যে সকল প্রাত্যহিক অধিকার এবং কর্তব্যবোধ তৈরি হওয়া উচিত, সেসব নিয়েই একটি পাঁচ সপ্তাহব্যাপী কর্মশালায় যোগদান করেছিল চাঁদনী। সেখানে সেখানে জাতিসংঘের স্বীকৃত শিশুর অধিকারের বিষয়ে মৌলিক ধারণাটিও লাভ করে সে। তখনই যেন চোখের উপর থেকে কালো পর্দাটা সরে যায় চাঁদনীর। বুঝতে পারে যে, কতটা ভুল এবং অস্বাস্থ্যকর এই বাল্য বিবাহ প্রথা। শুধুমাত্র শারীরিক নয়, মানসিক ভাবেও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কম বয়সে বিয়ে হওয়া মেয়েরা। অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের পর আসতে পারে গর্ভপাতের আশঙ্কা; বাচ্চার জন্ম দিলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারও অপরিণত এবং অপুষ্টির কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে কুড়ি কোটিরও বেশি মেয়ের বিয়ে বাল্য অবস্থাতেই হয়ে থাকে, যাদের মধ্যে ১৫ বছর পার হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায় ১০ কোটি বালিকার। সেই কর্মশালায় ‘ক্ষমতায়ন’ ব্যাপারটি গভীর রেখাপাত করেছিল চাঁদনীর মনে। যেন নতুনভাবে জন্ম নিয়েছিল চাঁদনীর ভেতর থেকে অন্য একটি মেয়ে, যার ভিতর থেকে সাড়া এসেছিল যেভাবেই হোক বন্ধ করতে হবে এই ভুল শতাব্দীপ্রাচীন প্রথা। কর্মশালায় শিক্ষার মাধ্যমে চাঁদনীর মতো মেয়েরা জানতে পেরেছিল কীভাবে শিশু অধিকারের বিষয়ে কথা বলতে হয়, জীবনে পড়াশোনা এবং স্বাস্থ্যের দাম কতটা এবং সর্বোপরি বিবাহই জীবনের মূল কথা নয়।
নিজের গ্রামে এবং অন্যান্য গ্রামেও বাল্যবিবাহ এবং শিশু শ্রমিকের বিরুদ্ধে রীতিমতো প্রচার করতে শুরু করে চাঁদনী। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বোঝায় কেন এই প্রথা বন্ধ করা উচিৎ এবং ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানো উচিৎ। প্রারম্ভিক ভাবে বেশ কিছু সমস্যার সামনে পড়লেও চাঁদনীর উদ্যোগেই যখন দু’জন শিশু শ্রমিককে আবার স্কুলে ভর্তি করানো হয় এবং তিনটি বাল্যবিবাহ আটকানো হয়, তখনই যেন সমাজের কাছে স্বীকৃতি পেয়ে যায় চাঁদনীর নাছোড় লড়াই। ভয় করেনি? জিজ্ঞেস করলে সহজে মাথা নাড়ায় চাঁদনী। তবে জানাতে ভোলে না, তার পাশে আরো অনেকে এসে দাঁড়ালেই আরো অনেক সাহসের সঙ্গে ভবিষ্যতে এই কাজ করে চলবে সে।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
১৩ বছরের কিশোরীর কবরের জন্য জমি দিলেন দরিদ্র হিন্দু কৃষক, সম্প্রীতির উদাহরণ হরিয়ানায়