প্রকাশ্য বেত্রাঘাত ১৫ বছরের সুশীলকে; ক্ষুদিরাম নয়, কিংসফোর্ড-হত্যায় যাওয়ার কথা ছিল তাঁরই

সালটা ১৯০৭। বছর দুয়েক আগে লর্ড কার্জন ভেঙে দিয়েছেন বাংলাকে। একের পর এক স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিপ্লবীদের জেলে পোরা হচ্ছে। আলিপুর আদালতে বিচার বসছে হরদমই। বিচারকের আসনে যে মানুষটি বসে আছেন, তিনি সমস্ত বিপ্লবীদেরই অন্যতম লক্ষ্য। ম্যাজিস্ট্রেট ডি এইচ কিংসফোর্ড। স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক কুখ্যাত নাম। নৃশংসতায় সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ব্রিটিশদের এমন ‘সোনার শাসনে’ এই নেটিভ বিপ্লবীদের কোনো স্থান নেই; তাই চালিয়ে যেতে লাগলেন অমানুষিক বিচার প্রক্রিয়া। এদিক থেকে ওদিক হলেই জেল!

সেইসময় আলিপুর আদালত চত্বরের সামনে ভিড় জমত সাধারণ মানুষের। প্রতিবাদ, ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি, সঙ্গে পুলিশের মার। ১৯০৭ সালের ওই বিশেষ দিনেও একইরকম লাঠিচার্জ চলছে। হঠাৎ পুলিশের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল বছর পনেরোর একটি কিশোর। চোখে আগুন। সামনেই ছিলেন একজন ইন্সপেক্টর। পাল্টা কয়েক ঘা দিয়ে দিল ওই পুলিশকে। এত বড়ো সাহস এই কিশোরের! টানতে টানতে নিয়ে গেল কিংসফোর্ডের কাছে। একটু অবাকই হয়ে গেলেন প্রথমে। এত ছোটো ছেলেকে কেন টেনে আনা হল। কিন্তু কারণটা জেনে অবাক হয়ে গেলেন। এর তো শাস্তি দিতেই হবে! নিদান দিলেন বেত্রাঘাতের। পনেরো বছর বয়স, অতএব পনেরোবার বেত্রাঘাত। সবার সামনে নিয়ে গিয়ে মারা হল ওই কিশোরকে। সবাই আঁতকে উঠলেন এমন আচরণে। কিন্তু কিশোর সুশীল সেন নির্বিকার। তার চোখে এখনও জ্বলছে আগুন। প্রতিবার পিঠ লাল করে দিচ্ছে বেত; আর ততবারই সুশীলের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে ‘বন্দে মাতরম’!

সুশীল সেন সেই ছোটো বয়স থেকেই জড়িয়ে পড়েছিলেন বিপ্লবের সঙ্গে। বাবা ছিলেন শিলংয়ের আই জি কার্যালয়ের প্রধান করণিক। জন্মই হয়েছিল এমন সময়, যখন গোটা দেশ ফুটছে। এমন ঢেউয়ে সুশীল গা ভাসাবে না, তা কী করে হয়? সিলেটে জ্ঞানেন্দ্রনাথ ধরের গুপ্ত সংগঠনে যোগ দেন মাত্র ১৩ বছর বয়সে। বক্সিং, লাঠিখেলা, জিমন্যাস্টিক— সমস্তভাবে শারীরিক দিক থেকে তৈরি হচ্ছেন। মানসিকভাবেও প্রস্তুত করে নিচ্ছেন নিজেকে। চারিদিকে চলা ব্রিটিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে নামতে যে হবেই! 

এর মধ্যেই ঘটে গেল বেত্রাঘাতের ঘটনা। ব্যস, এই একটি ঘটনাই সুশীলকে নিয়ে এল আন্দোলনের সামনে। লক্ষ্য একজনই, কিংসফোর্ড এবং অবশ্যই, ব্রিটিশ সরকার। আর পড়াশোনা? অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র সুশীল সেই দিকেও এগোচ্ছিলেন জোর কদমে। ম্যাট্রিকে তো ভালো ফল করেনই, সেই সঙ্গে স্নাতক স্তরে রসায়নে স্বর্ণপদক। এমন ছেলের সামনে ছিল উজ্জ্বল একটি ভবিষ্যৎ। সেসবে গেলেন না সুশীল। ব্রিটিশদের শায়েস্তা করতে না পারলে তিনি ঠান্ডা হবেন না।

সুযোগও এল। কিংসফোর্ডকে মারার গুরুদায়িত্ব বারীন ঘোষ প্রথমে তুলে দিয়েছিলেন সুশীল সেন এবং প্রফুল্ল চাকীর হাতে। ঠিকই ছিল সব, এমন সময়, পরিবারে নেমে এল দুর্যোগ। বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়লেন সুশীলের বাবা। ডাক্তার বলছেন, মৃত্যুর আর বেশি দেরি নেই। এমন অবস্থায় সুশীলকে ছাড়তে পারলেন না বিপ্লবী নেতারা। তাঁর ফেলে যাওয়া সেই জায়গা নিল মেদিনীপুরের আরেক তরুণ ক্ষুদিরাম বসু। বাকিটা, ইতিহাস… 

সুশীলেরও শেষ সময় বোধহয় এর মধ্যেই লিখে ফেলেছিলেন বিধাতাপুরুষ। সালটা ১৯১৫। বিপ্লবীদের জন্য টাকা ও অস্ত্রের যোগানের জন্য সেই সময় বেশ কিছু ডাকাতির ঘটনাও ঘটত। তেমনই একটি ঘটনায় যুক্ত ছিলেন সুশীল। জায়গাটা ছিল নদীয়ায়। তক্কে তক্কে ছিল ব্রিটিশ বাহিনীও। ছয় জনের দলটি ঘিরে ফেলে তাঁরা। গুলির লড়াইয়ে মারাত্মক জখম হন সুশীল। দুই পায়েই গুলি লাগে। এদিকে কার্তুজও শেষ হয়ে আসছে। আর লড়াই করা যাবে না। এবার? এক মুহূর্ত ভাবলেন তিনি। তিনটি রাস্তা; আত্মসমর্পণ, সকলের স্বেচ্ছামৃত্যু এবং সুশীলকে ফেলে রেখে পলায়ন। শেষে উপায় বাতলে দিলেন তিনি নিজেই। সতীর্থদের বললেন, এভাবে হবে না। বাকিদের বাঁচতে হবে যে করেই হোক। সুশীলের কথামতো, অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁকে গুলি করে সতীর্থরা। কেউ কেউ বলেন, সুশীলের নির্দেশমতো, তাঁর মৃতদেহ যাতে ব্রিটিশদের হাতে না পড়ে, তাই জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এটা কতটা সত্যি, সেটা ঐতিহাসিকরাই বলতে পারবেন। ততক্ষণ, একটি তরুণ, মেধাবী বিপ্লবীকে স্মরণ করে নিই আমরা।

Powered by Froala Editor

More From Author See More