‘জাদু হ্যায় কলকাতামে, খিঁচকে লাতি হ্যায় ফির’- কেমন আছে কলকাতার ভিস্তিওয়ালারা?

এই শহরে ঢোকার রাস্তা অনেক। বেরোনোর রাস্তা নেই। যাঁরা আসেন, কোনো এক মায়ায় তাঁরা আটকে পড়েন। তাঁদেরই একজন মহম্মদ আরশাদ। পেশায় ভিস্তিওয়ালা। কলকাতার বিলুপ্তপ্রায় পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের একজন।

পুরোনো কলকাতা বলতেই অনেকের চোখে ভাসে ভোর-ভোর চায়ের দোকানের উনুন জ্বালানো থেকে গঙ্গা স্নানের জন্য মানুষের ঢল। কিন্তু তার মধ্যেও অনেকেরই চোখে পড়ত ঝকঝকে রাস্তাঘাট, আর ভিস্তিওয়ালার মশক কাঁধে রাস্তা ধোয়া। বহু পুরোনো এই পেশায় যাঁরা যুক্ত ছিলেন, আধুনিক কলকাতায় তাঁরা আজ প্রায় ডোডো পাখির মতোই অদৃশ্য। শুধু কলকাতা নয় ছবিটা প্রায় সারা দেশেই এক। তবু উত্তর আর মধ্য কলকাতার কিছু জায়গায় এখনও টিমটিম করছে তাঁদের ক-জন। শ্যামবাজার, নিউমার্কেট এলাকায় এঁদের দেখা মেলে। তেমনই এক ভিস্তিওয়ালা মহম্মদ আরশাদ। তিরিশ বছর ধরে মশক কাঁধে জল বয়ে চলেছেন। নিউ মার্কেটের পেছন দিকে চার নম্বর মার্কেট স্ট্রিটের দোতলায় পায়রার খোপের মতো সারি সারি ঘরের একটিতে। কথা বলতেই বেরিয়ে এল একরাশ ক্ষোভ।

আপনার বাড়ি কোথায়?

কাটিহার জেলার বাসা গ্রামে আমার বাড়ি। (অন্য প্রশ্ন করার আগেই ঝাঁঝিয়ে ওঠেন) ইয়ে সব ইন্টারভিউ করকে আমারা কেয়া ফায়দা, জনাব! মিলেগা কিছু? সুধার হোগা হালাত মে? লোগ আতে হ্যায়, ফোটোউটো খিঁচতে হ্যায়, পার হাম তো জ্যায়সা কে ত্যায়সেই রহেতে হ্যায়। খালি পিলি টাইম খোটি হোতা হ্যায় আমার। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠান্ডা করার পর প্রশ্ন শুরু করি।

এটা কি আপনাদের পারিবারিক কাজ?

হা, জনাব। দাদা, পরদাদা কে টামিসে ইয়েই করতে হ্যায় হামলোগ।

দিনে কত টাকা পান?

এক ভিস্তি জলের দাম ১০ থেকে ১৫ টাকা। ৩০০-৩৫০ টাকা হয় একদিনে। পার্টি অনুষ্ঠান থাকলে একটু বেশি হয়।

এইসব ভিস্তি কী দিয়ে তৈরি?

ছাগলের আস্ত চামড়া দিয়ে তৈরি হয় ভিস্তি। ছাগলের ছামড়া গলা থেকে পায়ের অর্ধেক অব্দি ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। তারপর সেই গোটা চামড়ার পেট সেলাই করা হয়। শুধু গলার কাছটা খোলা থাকে সেখান দিয়ে জল ভরার জন্য।

কোথায় তৈরি হয় এই ভিস্তি? দামই বা কত?

দেখিয়ে জানাব, এই ভিস্তি তৈরি হয় পার্ক সার্কাস ৪ নম্বর ব্রিজের কাছে। তবে আমরা কিনি এই মার্কেট স্ট্রিটের ৩২ নম্বর মিশ্রি গলিতে শফিকের কাছ থেকে। ও-ই এগুলো বেচে। আগে থেকে অর্ডার দিতে হয়। একটা ভিস্তির দাম পড়ে ৩৫০০ টাকা।

সারা মাসে যা রোজগার হয় তাতে চলে?

কাহা চলতা হ্যায় বাবু? চালানা পড়তা হ্যায়। এই মেহেঙ্গার জামানায় পানি বেচে কত রোজগার হয়? তারপর এখানকার ঘরের ভাড়া আছে, খানাপিনা আছে, দেশের বাড়িতে পরিবারকে টাকা পাঠানো আছে।

অন্য পেশায় যাচ্ছেন না কেন?

আমার বয়েস হয়েছে বাবু। এখন উমর পচাশ-পচপন সাল। লেখাপড়া করিনি। তা ছাড়া বাপদাদা এই করে মরল, আমার শ্বশুরও এই কাজ করে। আগে তবু অনেক রোজগার হত। দিনে প্রায় ৮০০-৯০০ টাকা। অন্য আর কী কাজ করব। এই কাজ করেই তিন বোন আর দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। চলুক যদ্দিন চলে।

দেশে ফিরে যাচ্ছেন না কেন?

মন লাগে না বাবু, পাতা নেহি কিঁউ। দেশে বউবাচ্ছা আছে। তবু যখন দেশে যাই ভালো লাগে না। জানে কেয়া জাদু হ্যায় কলকাতামে। যখনই দেশে যাই, শালি খিঁচকে লাতি হ্যায় ফির। দশ দিনের বেশি থাকতে পারি না।

সারাদিন বাড়ি বাড়ি জল দিয়ে বেড়ান, এই চৌহদ্দির মধ্যেই। কলকাতা ঘুরেছেন?

ঘুরব কোথায়, কাজে না গেলে শুয়ে থাকি। ঘুমোই।

এত বছর কলকাতায় থেকেও কোথাও ঘোরেননি?

একবার সায়েন সিটি গিয়া থা। আচ্ছা নেহি লাগা।

বাড়ি থেকে বউ-বাচ্চাদের এনে কলকাতা দেখিয়েছেন কখনও?

নেহি বাবু। বহত রুপেয়া কা মামলা হ্যায়। ঘুমনে কে লিয়ে রহনা পড়েগা ইঁহা। রেহেগি কাঁহা উও লোগ।

কথা বলতে বলতে জানা গেল, আরশাদের বাড়ির একদম ধার ঘেঁষে মহানন্দা নদী। ছোটোবেলা থেকেই নদী তাঁকে টানত, দিনরাত ঝাঁপাঝাঁপি করতেন নদীর বুকে। মারও খেয়েছেন তার জন্য প্রচুর। নদীর ভাঙনে বহুবার তলিয়ে গেছে তাদের বাড়ি। জলের সঙ্গে তাঁর কী যেন এক সম্পর্ক রয়েছে। তখন কী আর জানা গিয়েছিল, একদিন এই জল বেচেই তাঁকে জীবন চালাতে হবে!

More From Author See More