তীব্র জলসংকটে পঁচিশটি দেশ, তালিকায় রয়েছে ভারতও

২০৬০ সাল। রুক্ষ-শুষ্ক পৃথিবীর বুকে চলছে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি। এবারের লড়াই জলের জন্য। বিশ্ব থেকে নিঃশেষ হয়ে গেছে পানীয় জল। মাটির গভীরে সঞ্চিত সামান্য জলভাণ্ডারের অধিকারের লড়াইয়ে নেমেছে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলি। 

না, এ দৃশ্য কোনো হলিউডি সিনেমার নয়। বিশ্বের জলসংকট নিয়ে সাম্প্রতিক রিপোর্টের নিরিখে অনিবার্য মনে হতে পারে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ। কিছুদিন আগেই ইরাক ও আফগানিস্তানের মধ্যে সংঘটিত হয়েছে ‘জলযুদ্ধ’ (Water war)। নদীবাঁধ নির্মাণ ও জলের অধিকার নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছিল দুই দেশ। এই জলযুদ্ধ-ই যেন নিয়তি হতে চলছে পৃথিবীবাসীর। কারণ ‘ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট অ্যাক্যাডাক্ট ওয়াটার রিস্ক অ্যাটলাস’-র সমীক্ষা অনুযায়ী ২৫টি দেশ তীব্র জলংকটের (Water scarcity) মুখোমুখি হতে চলেছে। যার মধ্যে আছে ভারতও।

জনসংখ্যার হিসেবে বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ মানুষ এই মুহূর্তে পানীয় জলের অভাবে ধুঁকছেন। বিশ্বের ২৫টি দেশের মধ্যে বাহরিন, সাইপ্রাস, কুয়েত, লেবানন বা ওমানের বিস্তীর্ণ অংশে জলসংকট অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে রয়েছে। অন্যদিকে অর্ধেক বিশ্ববাসী, অর্থাৎ ৪০০ কোটি মানুষকে বছরে অন্তত একটি মাস জলের সমস্যায় ভুগতে হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে ২০৫০-এর মধ্যে এই পরিসংখ্যান একলাফে ৬০ শতাংশ বেড়ে যাবে। 

তবে সর্বাধিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে চলেছে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলি। সেখানকার প্রায় ৮৩ শতাংশ মানুষকে নিত্যদিন জলকষ্টের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তুলনায় দক্ষিণ-এশিয়ার দেশগুলির ৭৪ শতাংশ মানুষ এই মুহূর্তে বিপদসীমার কাছাকাছি। রিপোর্ট অনুযায়ী মূলত চারটি দেশের জলসমস্যার জন্য ভবিষ্যতে বিশ্বের মোট জিডিপি-র বিরাট অংশ ব্যয় করতে হবে। দেশগুলি হল ভারত, মেক্সিকো, মিশর ও তুরস্ক। ২০১৬-তে যেখানে জলসংকট মোকাবিলার জন্য ১৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হয়েছিল, সেখানে ২০৫০-এ তা ৭০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছবে। যা সারা বিশ্বের জিডিপি-র প্রায় ৩১ শতাংশ। 

আরও পড়ুন
শুকিয়ে যাচ্ছে সমস্ত জলাধার, জলসংকটের শিকার কোলহাপুর সংলগ্ন ১৬০০টি গ্রাম

অত্যন্ত উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে ভারতের বর্তমান জলসংকটের চেহারাও। এই বছরের ‘ইউনাইটেড নেশনস’-এর রিপোর্টে ভারতকে পানীয় জলের সমস্যার ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৬-তে শহরাঞ্চলের প্রায় ৯ কোটি মানুষকে পানীয় জলের সমস্যায় ভুগতে হয়েছে। অনুমান, ২০৫০-এর মধ্যে এই সংখ্যা আড়াই কোটিতে পৌঁছে যাবে। 

আরও পড়ুন
জলসংকট নিয়ে দ্বন্দ্ব, সামরিক যুদ্ধের পথে এশিয়ার দুই দেশ

মহারাষ্ট্রের কোলহাপুর, সাংলি বা সাতারা জেলার প্রায় ১৬০০ গ্রামে পানীয় জলের হাহাকার তীব্র আকার নিয়েছে। বিগত এক দশকেও ছবিটা বদলায়নি। শুকিয়ে গেছে একাধিক জলাধার। পানীয় জল তো দূরের কথা, কৃষিকাজের জলও দুষ্পাপ্য হয়ে পড়ছে। এশিয়ার যে ৮০ শতাংশ মানুষ জলের অদূর ভবিষ্যতে সমস্যায় পড়তে চলেছে, তার মধ্যে ভারতের অবস্থাই সবচেয়ে চিন্তার।

সমস্যার গভীরে পৌঁছলে উঠে আসছে অসংখ্য কারণ। সারা বিশ্বজুড়ে নগরায়নের নামে লাগাতার অরণ্যধ্বংস, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনকে বিশেষজ্ঞমহল বর্তমান জলসংকটের প্রধান কারণ রূপে চিহ্নিত করছেন। ক্রমে ফুরিয়ে আসছে মাটির তলার জলও। অথচ পানীয় জলের সমস্যার মোকাবিলায় কি আদৌ পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে? বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই রাজনৈতিক নেতা, সরকারপক্ষ, এমনকি সাধারণ মানুষেরও। সারা বিশ্বজুড়েই প্রায় এক অবস্থা। জলসংরক্ষণের ব্যবস্থা, জল ব্যবহারের দীর্ঘমেয়াদি নীতির অভাবে সমস্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

উদ্বেগ সেখানেই। রিপোর্টের চোখরাঙানি বন্দি হয়ে পড়ে থাকছে কাগজের ভাঁজে। ২০৫০ পর্যন্ত যেতে হবে না, অবিলম্বে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে ‘জলযুদ্ধ’-এর চেহারা তার আগেই ভয়ানক আকার ধারণ করবে।

Powered by Froala Editor