কলকাতার প্রথম হ্যান্ড শ্যাডোর অনুষ্ঠান, গোটা বিশ্বকে টেক্কা দিয়েছিল দুই বাঙালিই

ছেলেখেলা হোক আর খেলার ছলেই হোক, ১৯৭২ সালে হাতের ছায়া নিয়ে যে চর্চাটা শুরু করেছিলাম, এই প্রবহমানতার কাছে তার অস্তিত্ব রক্ষার দায়ভারটা অবশ্যই মহাকালের! ঘটনার সময়টায় তাকে কোনো কাহিনির সূত্রপাত বলে ধরা যায় না। বহুবছর কেটে যাবার পর হঠাৎ পিছন ফিরে তাকালেই দেখা যায় তৈরি হয়ে গেছে কাহিনির রূপরেখা। যেটা মনে পড়ছে, সেটার ব্যাপারটাও তাই।

‘সব্য’ মানে আমার করচ্ছায়া উপস্থাপনার সহকর্মী সব্যসাচী সেন আমার জীবনে আসে ম্যাজিকের মাধ্যমেই। বন্ধু হবার পর হাতের ছায়া নিয়ে কাজ করতে করতে কেটে গিয়েছিল প্রায় সাড়ে ষোলো বচ্ছর! আমাদের হাতে তখন মানুষকে চমকে দেবার বেশ কিছু উপাদান তৈরি। এবার সাধারণ মঞ্চে এই নতুন শিল্পটিকে দর্শকের সামনে উপস্থিত না করলেই নয়। ১৯৮৮-র ২৮ ডিসেম্বর আউট্রাম ক্লাবে একটি সান্ধ্য অনুষ্ঠানের কথা হল। প্রসঙ্গত সেই সময় পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে কতিপয় করচ্ছায়াবিদ যে উপস্থাপনা করছেন, তার সময়সীমা ৯ মিনিট থেকে ১২ মিনিটেই সীমাবদ্ধ। দুরু দুরু বুকে আমরা ১৯ মিনিটের একটি শো নিয়ে হাজির হয়েছি। ছায়ার এই অনুষ্ঠানটির ব্যাপারে কেউ কিচ্ছু জানেন না। আমাদের সম্বল বলতে একটা ৩ ফুট বাই ৪ ফুট স্ক্রিন, তার পিছন থেকে ফেলে আলোছায়ার অনুষ্ঠান করার জন্যে একটি বালব। বালবটির বিচ্ছুরণ ক্ষমতা মাত্র ৩ ওয়াট (আজকের অনুষ্ঠান হয় ৫৫ থেকে ১২৫ ওয়াটে)।

যিনি আমাদের শো-এর বন্দোবস্ত করেছিলেন, তাঁর টেনশনটি যে মাত্রাছাড়া ছিল তা বলাই বাহুল্য। সব অন্ধকার করে, নিজের হাতে বানানো ও রেকর্ড করা মিউজিক চালিয়ে দিয়ে শুরু হল, তৎকালীন পৃথিবীর দীর্ঘতম হাতের ছায়ার অনুষ্ঠানের প্রাথমিক সূচনা।

এদিকে আমরা তো পর্দার পিছনে, দর্শকদের মুখ দেখতে পাচ্ছি না! রুদ্ধশ্বাস প্রায় মিনিট ১২ কেটে যাবার পরও যখন কোনো সাড়াশব্দ মিলছে না, তখন সেই হিমেল সন্ধ্যাতেও ঘামতে আরম্ভ করলাম আমরা। কিন্তু কি আর করা? ক্যাসেট শেষ না হলে থামতেও তো পারব না! ধরেই নিলাম ওধারে দর্শককুল নির্ঘাৎ অপসৃয়মান! এমতাবস্থায় আমরা একটা স্টেজ রিহার্সাল করছি মাত্র। অবশেষে নির্ধারিত সময় পার করার পর আমরা জ্বলে ওঠা ফুটলাইটের সামনে এসে দাড়ালাম। একি? দর্শক তো ঠাসা! তাহলে এত চুপচাপ কেন? আমরা একটু বাও করার চেষ্টা করতে গোটাকতক খৈনি-তালির আওয়াজ হল। আমরা একটু আড়ষ্ট কিন্তু তারপর আমাদের হতভম্ব করে দিয়ে তালি আর চিৎকারের ঝড় বয়ে গেল। স্টেজ থেকে তো নামলাম, বেশ কিছু দর্শক ঘিরে ধরলেন। সব্যসাচী কুণ্ঠাভরে জিজ্ঞেস করল, ‘মাঝখানে কোনো তালির শব্দ পাচ্ছিলাম না তো?’ এক মহিলা সহাস্যে বললেন, ‘আসলে ব্যাপারটা এতটাই নতুন যে আমরা ভয় পাচ্ছিলাম হাততালি দিতে গিয়ে পাছে কিছু মিস্ করে যাই? এই সময় কে একটা যেন পিঠটা চাপড়ে দিল; আমার চোখে আলোর উৎসগুলো গোল গোল জালিদার হয়ে গেল, সব ঝাপসা। ষোলো-ষোলোটা বছরের কঠোর সাধনার পর প্রথম এই পরীক্ষাটায় পাশ করে পকেটটা হাতড়াতে লাগলাম, রুমালটা দরকার!

তারপর পিছন ফিরে তাকানোর অবকাশ হয়নি। আজকে সবাই জানেন ‘করচ্ছায়া’টা কী। কিন্তু তখন ব্যাপারটা বোঝানোর জন্য ‘শো’টাই ছিল একমাত্র সম্বল। বিশেষ করে আয়োজকদের বোঝানোটা যে কী ঝকমারি ছিল, তা আজকের দর্শকরা হয়তো কিছুটা অনুমান করতে পারবেন। সেই বত্রিশ বছর আগে শুরু করা এই চ্যালেঞ্জিং শোটা তখন মানুষকে মুগ্ধ করছে তার নিজস্ব জাদুতে। বাংলার সীমানা ছাড়ালাম। দূরদর্শনে কাজ করলাম বার কতক। খ্যাতির হাওয়া গায়ে লাগতে শুরু করল। বেশ কিছু জল গঙ্গা দিয়ে বয়ে যাবার পর এসে গেল আমাদের প্রথম বিদেশ যাওয়ার সুযোগ। ইতোমধ্যে তৎকালীন কুইজ-কে বেশ জনপ্রিয় করে তুলেছেন কলকাতার নিল ও ব্রায়েন। তাঁর সুযোগ্য পুত্রেরা অর্থাৎ ‘ব্যারি’ ও ‘ডেরেক’ হাল ধরেছেন কুইজের। এঁদের মধ্যে দূরদর্শিতা, মার্কেটিং আর ঝুঁকি নেবার ক্ষমতা ডেরেককে ধীরে ধীরে দেশের গণ্ডি পার করিয়েছে। সালটা সম্ভবত ৯৪-এর মাঝামাঝি। ডেরেকের অফিসে বসে কথা হচ্ছিল। উনি প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা অমরদা, আপনাদের এই হ্যান্ডশ্যাডো দিয়ে কুইজ করা যায় না?’ বললাম, ‘কেন যাবে না। একটু ভাবলেই হবে।’

আরও পড়ুন
অস্ট্রেলিয়ায় প্রাচীন গুহাচিত্রের সন্ধান, ফুটে উঠেছে জাদুবিশ্বাস

পরিকল্পনা হল। নতুন কাঠামোয় উপস্থাপনার রাস্তাও ভাবা হল। সেটা আমাদের কাছেও নতুন বৈকি। কলকাতার ডালহাউসি ইন্সটিটিউটের প্রাঙ্গণে হল ‘নর্থ স্টার কুইজ কনটেস্ট’। কুইজে প্রথম হাতের ছায়ার ব্যবহার বিলক্ষণ নতুন মাত্রা পেল। আমাদের মঞ্চে ডেকে নিয়ে সেদিনের সম্মানিত উপস্থাপক স্বয়ং নিল ওব্রায়েন দর্শককে প্রশ্ন করলেন, ‘এবার একটা কুইজের জবাব আপনারা দিন তো? এই দুজন হ্যান্ডশ্যাডোগ্রাফারের নাম বলতে পারেন? ওঁকে অবাক করে আর আমাদের শিহরিত করে প্রায় পঁচিশ ভাগ দর্শক সোচ্চার হয়ে বললেন, “অমর, সব্যসাচী!” কারণ ততদিনে আমাদের বহু অনুষ্ঠান মঞ্চে ও টেলিভিশনের সর্বভারতীয় স্তরে প্রচারিত হয়ে গেছে।

উৎসাহিত ডেরেক এই নতুন মাধ্যমটিকে তাঁর নিজের বুদ্ধিমত্তায় আরেকটি পরীক্ষায় আমাদের ডাকলেন। ‘নেসলে কুইজ কনটেস্ট’! বিপুল সাফল্য। ব্যস এর কিছুদিন পরে উনি বললেন, ‘অমরদা, সব্যসাচীদা চলুন এবার একটু বিদেশ যাওয়া যাক’। কোথায়? ওমানের মাসকটে। সেখানকার সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্র ‘টাইমস অব ওমান’-এর আমন্ত্রণে আমরা গেলাম মাসকটে। সেখানকার প্রায় ৬ হাজার দর্শকাসনের অ্যাম্ফিথিয়েটারে হল সেই অনুষ্ঠান। প্রথমেই চমক। পূর্ণ অন্ধকার স্টেজে ডেরেকের কণ্ঠ শোনা গেল ছোট্ট একটি আলোকিত পর্দায় ছায়ার বাতাবরণে। সেখানে বেশ কিছু ছায়াবয়ব দেখানোর পর ভেসে উঠল ডেরেকের চশমা পরা মুখের ছায়া কথা বলছে, ‘ভাবছিলাম আজকের কুইজটা আমি এইরকম ছায়া হয়েই পরিচালনা করব। কিন্তু রসিকতা থাক, আমি এই ছায়াশিল্পীদের দ্বারা ওভার শ্যাডোড হতে চাই না।’ এর পরেই দর্শককুল সচকিত হয়ে বেশ দূরে আলোক বৃত্তের মাঝখানে ডেরেকের আসল চেহারা দেখলেন, আর তখন ছায়ার পর্দায় ডেরেকের মুখটি ধীর গতিতে দশটি আঙুলের চেহারা নিচ্ছে! হর্ষধ্বনিটি দিয়ে শুরু হল কুইজের অনুষ্ঠান। তার প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পরে এল, আমাদের করচ্ছায়ার প্রথম আন্তর্জাতিক কুইজের পালা। আগের দিন হোটেলের ঘরে ডেরেক জানতে চাইলেন এই অংশের প্ল্যানিংটা কী? বললাম দুটো ‘C’ দেব তোমাকে। একটা ‘Cartoon’ আরেকটা ‘Cricket’। বেশ কার্টুনটা দেখি। দেখলাম, দেখে মন্তব্য হল, ‘না এটা বড্ড বেশি সহজ হয়ে যাচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা টিনটিন! না আরেকটু কমপ্লেক্স চাই। আমার তখন ভয় হচ্ছে। কী ভয়? দর্শক জটিল ছায়া ধরতে না পারলে তাদের দোষ নেই কিন্তু সেটা হবে ছায়াকারের অক্ষমতা। 

আরও পড়ুন
লকডাউনে বন্ধ উপার্জনের পথ, পেশা বদল করছেন জাদুকর থেকে বুকিরা

কী আর করার! আরেকটা ছায়া করে দেখালাম, একটু থমকানো প্রশ্ন এল, এটা কি Uderzo-র করা Asterix-এর মুখ?’ হাসলাম, ‘ঠিক’। তাহলে অমরদা এটাই থাক। আর ক্রিকেট? দেখালাম। ‘এটা কি সৌরভ?’ সব্য হেসে বলল ঠিক ধরেছ। আমি কিঞ্চিৎ সংশয়ী। বলেই ফেললাম, প্রশ্নটা হু ইজ দিস ক্রিকেটার হবে তো? ডেরেক হাসল, ‘অমরদা তোমাদের ছায়াটা তোমরা কর প্রশ্নটা আমিই করব’। ভালো কথা।

পরদিন দ্বিতীয় ভাগে যখন আবার স্টেজ অন্ধকার হল। আমি কার্টুন দেখালাম। পিছন থেকে শুনলাম রেসপন্ডিং বেল বাজল। ‘Ok, tell me.’ উত্তর এল, ‘I think that’s Asterix’। ‘Right’। ব্যাকড্রপের পিছনে আমাদের মুখে নিশ্চিন্ততার তৃপ্তি। কিন্তু গোলমাল বাঁধল দ্বিতীয় প্রশ্নে। ওমানের প্রায় সাড়ে তিনশো দল। বছরভর নক আউট করতে করতে ফাইনালে মাত্র ছ’টিতে এসে দাঁড়িয়েছে। পুরস্কারের বহরও বিপুল। রানার আপ দল ফ্রিজ ইত্যাদি পাবে। বিজেতাদের জন্য বরাদ্দ ভারী সোনার চেন। টেনশন আছে বৈকি।

আরও পড়ুন
বাঁশির জাদুতে হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি, ‘বঙ্গাল কা শের’ পান্নালালকে কি মনে রেখেছি আমরা?

ডেরেক আমাদের কাজের ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী। আমি আঙুলের মোচড়ে সৌরভ গাঙ্গুলির মুখচ্ছবি ফোটালাম পর্দায়। শুনতে পেলাম ডেরেক প্রশ্ন করছেন, “হু ইজ দিস এমিনেন্ট ইন্ডিয়ান?’ পুরো চরাচর স্তব্ধ! নিজের হার্টবিট নিজেরই হাত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। (মনে রাখা দরকার ’৯৭ সালে সৌরভ গাঙ্গুলির আন্তর্জাতিক খ্যাতি তুলনায় অনেক কম ছিল।) অত হাজার দর্শক চুপ। ‘সেকেন্ড’ পেরিয়ে যাচ্ছে। আমাদের শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যাচ্ছে হিমস্রোত। হয়তো সেই মুহূর্তে কুইজ মাস্টারও ভাবছেন, ক্রিকেটার না বলে ইন্ডিয়ান বলাটা কি বেশি হয়ে গেল? দমবন্ধ ১৯ সেকেন্ড পার করে ‘টিং’ করে ঘণ্টা বাজল, কেউ রেসপন্ড করেছেন! উদ্বিগ্ন ডেরেকের গলা পেলাম, ‘ইয়েস?’ একটি ক্ষীণ কিশোরীর কণ্ঠ শুনতে পাওয়া গেল, “ইজ ইট সৌরভ গাঙ্গুলি?” কুইজ মাস্টার উদ্ভাসিত, “ইয়েস ইয়েস, রাইট ইউ আর! থ্যাঙ্ক ইউ।” বুক থেকে নামল এক বিশমণি পাথর। সব্যসাচী দুহাতের আনন্দিত আঙুল তুলে ‘ভাঙড়া’র ভঙ্গিতে কাঁধ নাচাচ্ছে! আর আমি ভঙ্গীকৃত আঙুলের জট ছাড়াতে ছাড়াতে অনুভব করলাম, চোখদুটো আবার ঝামেলা করছে।

Powered by Froala Editor

More From Author See More