জলপাইশাখার মধ্যে দিয়ে যেতে (দ্বিতীয় পর্ব)

ছবি - থ্রু দ্য অলিভ ট্রি’জ
পরিচালনা – আব্বাস কিয়ারোস্তামি
দেশ – ইরান
সাল – ১৯৯৪

স্থান বা স্পেসকে আমরা আবারও দেখছি কিউবিস্ট ভঙ্গিতে, একবার এ-পিঠ, পরের বার অন্য পিঠ। ফলে দৃষ্টির মধ্যে বিকৃতি ঘটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং স্পেসেও ফাটল ধরে যাচ্ছে, তা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।

দোমড়ানো মোচড়ানো স্পেসে সময় (টাইম)-এর চোরা সুড়ঙ্গ (ফ্লাক্স) তৈরি হয়ে যাচ্ছে।

স্পেসই কি টাইমকে ধরে রাখে? কেননা স্পেস তো স্থাণু, জড়, ধ্রুবক।

স্পেসের উপর ধৃত থাকে স্মৃতি, সময়!

সেই অতীত সময় এখন জ্যান্ত হয়ে উঠছে, হ্যালুসিনেশন হয়ে যাচ্ছে বাস্তব।

প্রকৃতি এক ধ্রুবক ক্যানভাস। তাতে শুধু বস্তু (অবজেক্ট)গুলি সরে যায়, মুছে যায়, জন্মায়, পালটে যায়।

জড় কিংবা জীব, দু ধরণের অবজেক্টেরই বয়স বাড়ে। গাছের গুঁড়ির বাকল খসে যায়, মানুষের চেহারা বদলে যায়। ভূমি ফেটে যায়, পৃথিবী পালটে যায়।

আরও পড়ুন
জলপাইশাখার মধ্যে দিয়ে যেতে

অর্থাৎ স্পেসই হল অনন্ত আধার, কেননা আমাদের জগত অনন্ত।

টাইম = আধেয়?

নাকি সবটাই উলটো?

স্পেস কি টাইমেই ধরা থাকে?

কে কাকে ধরে আছে – কে বলবে!

লক্ষ করুন, দৃষ্টি তো সমস্ত প্রাণীরই আছে, কিন্তু সৌন্দর্যবোধ থাকে মানুষের!

তার বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সে বাস্তবকে একটি ফ্রেম বা গণ্ডি দেয়, দৃষ্টির সীমানা নির্দেশ করে।

শিল্পী চাইলেও একচিলতে বাস্তব তৈরি করতে পারবে না, কারণ সমস্ত বাস্তবই হল প্রাকৃতিক, প্রকৃতি-সৃজিত। শিল্পী নিজেও তাই।

শিল্পী যা পারে, তা হল দেখার চোখ ও মন পালটে ফেলতে, প্রকৃতি থেকে নির্বাচন ও সম্পাদনা করতে!

শিল্পী এদিক থেকে স্বয়ম্ভূ, ঈশ্বরতুল্য, কারণ সে নিজের স্বপ্নতুল্য বাস্তব তৈরি করে নেয়, এবং তাকে দৃশ্যমান করে তোলে।

কিন্তু মূল বাস্তবটির পরিকল্পনা কে করেছিল?

যদি মূল বাস্তব কিছু থেকে থাকে – তা কি ঈশ্বরের দেখা স্বপ্ন?

কিয়ারোস্তামি কখনোই তথাকথিত ‘পরাবাস্তবিক’ কিছু দেখান না, যেমন বুনুয়েল বা দালির ছবি/ চিত্রে আমরা জাগ্রত দৈনন্দিনে অসম্ভব, উদ্ভট স্বপ্নতুল্য দৃশ্য দেখি। (যেমন, দম্পতির বেডরুমে ডাক পিয়ন ঢুকে পড়ছে সাইকেল নিয়ে)

কিয়ারোস্তামি শুধু দৃষ্টিকে ভেঙেচুরে দেন, বাস্তবকেও দৃষ্টির টুকরোয় ভেঙে দেন।

বাস্তব ভেঙে চুরে যায়, স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়ে যায়, সেই চোরাগোপ্তা উৎসারণ ঘটে, লৌকিকের মধ্যে অলৌকিক মুখর হয়ে ওঠে।

কিয়ারোস্তামি কখনোই স্বপ্ন দৃশ্য দেখাননি। (ফেলিনি যেমন ‘এইট এন্ড হাফ’-এর শুরুতে স্বপ্ন দেখান, বা সত্যজিৎ তাঁর ‘নায়ক’ ছবিতে।)

সমগ্র ছবিকে তিনি স্বপ্নে পরিণত করেন, বাস্তবের প্রতি আনুগত্যের চূড়ায় উঠে যান।

অত্যন্ত রঙচটা, সাদামাটা, নীরক্ত, ঘ্যানঘ্যানে, তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপার স্যাপার তাঁর ছবিতে ঘটতে থাকে, এবং আর কিছুই ঘটে না।

এই হল নভেলেস্ক গুণ, মহৎ উপন্যাসের গুণ। তুচ্ছতম পর্যবেক্ষণ অধিক মর্যাদা পায়। অর্থাৎ, প্লট বা গল্পের অধিক হয়ে যায় জীবন, গল্পের ‘বাস্তব’কে তাঁর ছবির আঙ্গিক মুছে দিতে থাকে - ক্রমে একেবারে আবছা করে ফেলে।

তাঁর সিনেমা গল্প ছাপিয়ে জীবনের বাস্তব হয়ে যায়।

ছবিতে ফিরে আসি। ছবি বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে।

শ্রীমতী শিভা গাড়ি চালাচ্ছেন, দুই কিশোরকে পথ চলতে দেখে থামান। তাঁর দৃষ্টি হল ক্যামেরার দৃষ্টি (পিওভি), সুতরাং আমাদের দৃষ্টি।

এদের দুজনকে আমরা চিনি। কোকের ত্রয়ীর প্রথম ছবি ‘হোয়ার ইজ মাই ফ্রেন্ডস হোম’-এর দুই চরিত্র। আহমদপুর ও রেজা।

তারা দুজনেই বড় হয়ে গেছে। তারা গাড়ির সামনে আসে। তাদের হাতে ফুলের টব।

অগ্রবর্তী সিনেমার দুই ফিকশনাল চরিত্র এবার তাদের জীবন থেকে উঠে আসে, তাদের বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে বর্তমান সিনেমায় ঢুকে আসে!

এরা কি বাস্তবের আওতা থেকে সিনেমার আওতায় ঢুকে এল?

দুই কিশোরকে আমরা দেখে চমকে যাই, কিন্তু কেন?

বাতাসের শিরশিরে শব্দ আসছে। প্রকৃতির শিরায় যেন রক্ত বইছে, অথবা কানে কানে রহস্যময় ফিসফিস...

বাস্তবতা ক্রমে প্রেতায়িত, ছমছমে হয়ে যাচ্ছে!

এই দুই কিশোরকে আমরা বালক অবস্থায় দেখি, তখন ১৯৮৭ সাল, মাত্র ৬ বছর আগের কথা।

তাদের বয়স সিনেমার সময়কে ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেছে।

অর্থাৎ প্রকৃত সময় চলচ্চিত্রীয় সময়কে খর্ব, অকেজো করে দিয়েছে।

তাদের শরীরে, মুখে সময় ধৃত হয়ে আছে।

প্রাণীর দেহে প্রাণের বিকাশের প্রত্যক্ষতায় সময়কে বোঝা যায়।

এখানে দুজন কিশোর যেন পৌরাণিক ফ্যারেশতাদের মতো এই গাড়িটির পিছু পিছু ছুটছে - আমরা দেখছি, গাড়ির আয়নায় তাদের অগ্রসর ছায়া।

যেন রহস্য ঘনিয়ে আসছে।

কিন্তু কেন রহস্য? অস্বাভাবিক কিছু তো ঘটেনি! হ্যাঁ, এদের বয়স বেড়েছে। তাতে কী? বয়স কি সকলেরই বাড়ে না?

কিয়ারোস্তামি কৌতুকের সঙ্গে বলছেন, দ্যাখো হে, দ্যাখো! সবচেয়ে স্বাভাবিক ব্যাপারগুলোই হচ্ছে সবচেয়ে রহস্যময়! তুমি জন্মেছ, তোমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে! তুমি বড় হয়ে যাচ্ছ, বুড়ো হয়ে যাচ্ছ। সময় চলে যাচ্ছে! সব কিছু চলে যাচ্ছে!

তুমি থেকে যাচ্ছ। তুমিও একদিন আর থাকবে না।

সময় এক কালো জাদুকর, সমস্ত কিছুর আড়ালে থাকা এক সক্রিয়, চির নীরব অশরীরী!

স্পেস বা স্থান হল তার গোলাম!

জলপাইশাখার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তুমি বুঝতে পারছ, কখন কীভাবে তার চোরা-টানেল খুলে গেছে। অদৃশ্য ফাটল দিয়ে স্মৃতি, ইতিহাস, পুরাণ, আদিমতা ঢুকে আসছে।

রেডিওতে যেন কী বলছিল?

‘আজ, ১৯৯৩, ৩০ মে, ১৪১৩ চান্দ্র হিজরি সনে আজকের দিনে ১৩৫৩ বছর আগে...’

কেননা এখন সব অলীক।

বাতাসের শিরশিরে শ্বাসে, বৃক্ষশাখার হাতছানিতে, আলোছায়ার কুহকে সেই মহান, প্রবীণ জাদুকর তাঁর ভোজবাজি শুরু করছেন।

এঁকে নমস্কার করো।