গোয়ালন্দ ঘাট, পদ্মার স্টিমার ও এক ‘গোপন’ মুরগির রেসিপির গল্প

বিশালকায় পদ্মা সামনে। বয়ে চলেছে নিজের গতিতে। কখনও তার আক্রোশ পাড়ের প্রতি। গিলে নিচ্ছে মাটি। কখনও আবার শান্ত হয়ে ধারণ করছে মানুষজনকে। নৌকা, ভেসেল, স্টিমার। দুপুরের রোদ এসে পড়ছে তার গায়ে। আর, আরিচা ফেরিঘাটের দিকে ভেসেল পাঠিয়ে দিয়ে, নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে গোয়ালন্দ। না, নিশ্চুপ নয় ঠিক। বিড়বিড় করে ‘দুগগা দুগগা’ বলে উঠল কি কোথাও?

আরও পড়ুন
বিলুপ্তির পথে ৩০০-রও বেশি নদী, ক্রমশ ভয়াবহ হয়ে উঠছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি

“নাম শোনছেন গোয়ালন্দ? স্টিমার ঘাটে ভাতের হোটেল।
ইস রে সে কী ইলশা মাছের সোয়াদ – কী ভাই, শোনছেন নাম?
হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ
দুষ্টু অসৎ হোটেল-মালিক পরদেশীয়া ধুর পাইলেই
বেকুব বানায় প্যাসেঞ্জারে। কেমনে জানেন?
না তো
খাইতে বইছে। অরা নিজেই ছোকরা দিয়া ঘন্টা বাজায়।
নূতন মানুষ ভাববে বুঝি জাহাজ ছাড়ার বেল দিতাসে – হুড়মুড়দুর -
বয়রা তখন পাতের থিকা আমাখা ভাত, মাছের টুকরা
তুলা রাখে। আবার যখন- ”
(রাতের ট্রেনে / পিনাকী ঠাকুর)

আরও পড়ুন
পড়াশোনার সুযোগ পাবে শরণার্থী কিশোররাও, উদ্যোগ বাংলাদেশে

অকালপ্রয়াত কবি পিনাকী ঠাকুরের লেখায় এভাবেই ধরা দিয়েছিল গোয়ালন্দ ঘাট। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, কবিতার ছবির সঙ্গে মেলাতে গেলে খানিক ঠেক লাগে বইকি! যদিও মেজাজে গোয়ালন্দ ঘাট বদলায়নি আজও। রাজবাড়ী জেলায়, পদ্মার তীরের এই জনপদ আজও নদী পারাপারের অন্যতম ঠিকানা।

আরও পড়ুন
লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে কলকাতার উৎসাহে মুগ্ধ বাংলাদেশের হাসান রোবায়েত

ইতিহাসও সেই কথাই বলে। সেই কোনকালে পর্তুগিজ, মগ, ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের আনাগোনা ছিল এখানে। পর্তুগিজ জলদস্যু গঞ্জালেসের নাম থেকেই ‘গোয়ালন্দ’ নামের উৎপত্তি, এমনটাই মনে করেন অনেকে। আবার, কারো-কারো মত, স্থানীয় গোয়ালপাড়া থেকেই ‘গোয়ালন্দ’-এর জন্ম।

আরও পড়ুন
চিত্রশিল্পীর স্মরণে মেলা, ব্যতিক্রমী উদ্যোগ বাংলাদেশের গ্রামে

সে যাই হোক, কলকাতা আর পূর্ববঙ্গের মধ্যে ‘বন্ধুত্ব’ রক্ষায় গোয়ালন্দের ভূমিকা অপরিসীম। ১৮৬২ সালে শিয়ালদা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত চালু হয় রেল চলাচল। আর, তার ন’বছর পরেই, কুষ্টিয়া থেকে রেলপথ সম্প্রসারিত হয় গোয়ালন্দ পর্যন্ত। সেটা ১৮৭১। তখন থেকেই, ঢাকা থেকে কলকাতায় যাওয়ার জন্য গোয়ালন্দ ছিল প্রধান ভরসা। এমনকি, গত শতকের ষাটের দশক পর্যন্তও, কলকাতা থেকে গোয়ালন্দ অব্দি যেতে ‘ঢাকা মেল’ ওপরই ভরসা করতেন নিত্যযাত্রীরা।

গোয়ালন্দ বিখ্যাত ছিল তার চিকেন কারির জন্য। ‘গোয়ালন্দ স্টিমার কারি’ – এই নাম আজ আর কারোর মনে পড়ে না চট করে। কিন্তু একসময় এই পদের নাম শুনলেই জিভে জল আসত বাঙালির। সৈয়দ মুজতবা আলী-র লেখাতেও উল্লেখ পাওয়া যায় এই পদের। স্টিমারের নাবিকরা নিজেদের জন্য বানাতেন এই পদ। এর স্বাদ চাখতে গেলে নিত্যযাত্রীদের সাধ্যসাধনা করতে হত যথেষ্ট। কিন্তু একবার খেলে, ভুলতে পারতেন না কেউই। আজকের গোয়ালন্দে এই পদ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

কী ছিল সেই ‘গোপন’ রেসিপি? একটা গোটা মুরগি কেটে নেওয়া হত প্রথমে। সঙ্গে লাগত তিন-চারটে বড়ো পেঁয়াজ, কয়েকটা রসুনের কোয়া, টুকরো আদা, শুকনো লঙ্কা। শুধু তাই নয়, একচামচ হলুদ, ছয়-সাদ চামচ সরষের তেল আর পরিমাণমতো লবণ নেওয়া হত। তারপর মুরগির মাংসের সঙ্গে মশলাগুলো মাখিয়ে, রেখে দেওয়া হত একঘণ্টা। সেই সময়ও পেরোলে, একটা বড়ো হাড়িতে সেই মাংস ঢেলে মাঝারি আঁচে খানিকক্ষণ ওলটপালোট করা। তারপর, ঢেকে রেখে দিলেই যথেষ্ট। মাংস নরম হলে, গরমাগরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন।

আরও পড়ুন
বিজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা গোটা বাংলাদেশ, খুলনার তখনও লড়ছে স্বাধীনতার জন্য

ঘাটের আশেপাশে এখনও দেখতে পাওয়া যায় অসংখ্য ভাতের হোটেল। মনে পড়ে পিনাকী ঠাকুরের কবিতাটির কথা। হ্যাঁ, গল্প হলেও সত্যিই ঘটত অমন। হোটেলগুলিতে কেউ খেতে বসলেই, ভোঁ দেওয়া হত স্টিমার থেকে। কখনও কখনও হোটেলের কর্মচারীরা নিজেরাই ঘণ্টা বাজাত। খাবার ফেলে পড়িমড়ি ছুটতেন যাত্রীরা। তারপর, সেই না-ছোঁয়া খাবার পাত থেকে তুলে নিয়ে, পরিবেশন করা হত পরের খরিদ্দারকে।

আরও পড়ুন
বাংলাদেশ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং কলকাতা— মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য দলিল

এমনই সব কাহিনি জড়িয়ে গোয়ালন্দের পরতে পরতে। বাদ যায় না পদ্মাও। বিশালাকার ভেসেলে পারাপার চলে এখনও। ভেসেলের ওপর গাড়ি, বাস, মানুষ। সঙ্গে অজস্র দোকান। হাঁক পাড়ছে ঝালমুড়িওয়ালা। কেউ হয়তো ঝুড়ি খুলে এগিয়ে দিল হাঁস বা মুরগির ডিম। ফল সাজিয়ে বসেছেন কেউ কেউ। এককোণের দোকানে সাজানো কেক-বিস্কুট-সিগারেট-চিপস। আর, সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেলেই ভাতের হোটেল। গরমাগরম ইলিশ মাছ ভাজা আর ভাত। খাও যত পারো। পদ্মার ইলিশ, সে কি মুখের কথা!

আরও পড়ুন
পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা পরাভূত – ভারত ফের উপমহাদেশের ‘সেরা’

না হে, মুখের কথা নয়। কিন্তু জিভের কথা তো বটেই! নইলে ভেসেলের ওপর রুপোলি আঁশে রোদের ঝিলিক দেখে মন নেচে উঠবে কেন! ঝুড়িতে প্রায় দশ-বারোটা ইলিশ মাছ। চোখগুলো যেন আমন্ত্রণ জানাচ্ছে স্বাদ নেওয়ার। বিক্রেতাও হাঁক দিতে দিতে ঘুরছেন এদিক-সেদিক। লোভ বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু কিনতে চাইলেই ঠেক খেতে হয়। একটা কেনা যাবে না। কিনতে হবে ঝুড়িভর্তি ইলিশই। দশ-বারোটা ইলিশ আর খান চারেক বিশালাকার চিংড়ি। পদ্মার বুকে ঘটি-বাঙাল ভেদ নেই। ইলিশ আর চিংড়ির সহাবস্থান সেখানে। বিক্রেতা দর হাঁকলেন ৭০০০ টাকা। অত মাছ নিয়ে কী হবে! অগত্যা, রুপোলি ঝলক দেখেই নিজেকে শান্ত করছেন যাত্রীরা।

আরও পড়ুন
বাংলা পড়তে পারে না বাংলাদেশের ৬৫% প্রাথমিক শিক্ষার্থীই!

কিন্তু ভেসেল পেরিয়ে নদীর দিকে তাকালে শান্ত হওয়ার জো কই! সামনে যে স্বয়ং পদ্মা! এপার-ওপার দেখা যায় না সহজে। আমাদের হুগলি নদী দেখে অভ্যস্ত চোখে বিস্ময় তো জাগবেই! নদীর বুক জুড়ে যাতায়াত অসংখ্য বিশালাকায় ভেসেলের। নামগুলিও কাব্যিক। ‘বনলতা’, ‘শাপলা শালুক’, ‘রজনীগন্ধা’, ‘মাধবীলতা’। মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে ‘ভাষা শহীদ বরকত’ কিংবা ‘বীরশ্রেষ্ঠ মোঃ রুহুল আমীন’ নামের ভেসেলও। কেউ গোয়ালন্দ থেকে আরিচায়, কেউ আবার আরিচা থেকে গোয়ালন্দে। আর দুয়ের মধ্যে শুয়ে আছে সর্বগ্রাসী পদ্মা, যে আবার ভালোবাসতে জানে। বাসাতেও…

আরও পড়ুন
এখনও অবধি ৪৬টি জেলায় গাছ লাগিয়েছেন বাংলাদেশের এই অধ্যাপক

নদীর গল্প এমনই। নিজের সঙ্গে, বহন করে অজস্র মানুষকেও। জনপদের দায়িত্বও তারই। আর সেই জনপদ যদি হয় গোয়ালন্দ, এক লহমায় আচ্ছন্ন করে দেয় মন। পূর্ববঙ্গ ছেড়ে কলকাতায় চলে আসার সময়, কেউ ভরসা রেখেছিল পদ্মাতেই। গোয়ালন্দে ছাপ পড়েছিল তার পায়ের। সেই ঘটনার পর কেটে গেছে অনেকগুলো দশক। দ্যাশ ভাঙ্গসে, ভাঙ্গসে কইলজাও। পদ্মা, তুমার গড়ন ভাঙ্গে নাই তো?

Latest News See More