আইকিউ আইনস্টাইনের প্রায় দেড় গুণ, বিস্মৃতির অতলে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান ব্যক্তিত্ব

যদি প্রশ্ন করা হয় পৃথিবীর ইতিহাসে বুদ্ধিমত্তার নিরিখে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি কে, তবে অধিকাংশ মানুষই তার উত্তরে বলে উঠবেন আইনস্টাইন কিংবা নিউটনের নাম। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের প্রতিভা সূচক বা আইকিউয়ের মান ছিল ১৬০। অন্যদিকে আইজ্যাক নিউটনের ক্ষেত্রে তা ছিল ১৯০। বছরখানেক আগে দক্ষিণ ভারতীয় এক কিশোরী হয়ে উঠেছিল বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। আইকিউ পরীক্ষায় তার ফলাফল এসেছিল ১৮০-র কাছে। তবে এঁরা কেউই নন, ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান ব্যক্তিত্ব উইলিয়াম জেমস সিডিস। একেবারে অচেনা লাগছে নিশ্চয়ই? ভাবছেন আবার কোনো তরুণ প্রতিভা উঠে এল নিশ্চয়ই? না, তা একেবারেই নয়, আড়াইশোর বেশি আইকিউ হওয়া সত্ত্বেও বিস্মৃতির আড়ালেই রয়ে গেছেন এই মার্কিন গণিতজ্ঞ।

১৮৯৮ সালে উইলিয়াম সিডিসের জন্ম নিউ ইয়র্ক শহরে। বাবা বরিস ছিলেন প্রতিভাবান মনোবিশেষজ্ঞ, মা ছিলেন একজন চিকিৎসক। তবে মেধার নিরিখে দু’জনের থেকেই উইলিয়াম ছিলেন অনেক বেশি উজ্জ্বল। উইলিয়াম কিশোর বয়সেই রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন আমেরিকায়। কারণ ২৬০ আইকিউ ফলাফল তার আগে কখনোই চোখে পড়েনি মানুষের। উইলিয়ামের পরেও আর এমন ব্যক্তিত্ব পা রাখেনি পৃথিবীতে। কিন্তু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হওয়ার পরেও এক অন্যরকম জীবন কাটাতে হয়েছিল তাঁকে। সহ্য করতে হয়েছে অপমান, সমালোচনা, যন্ত্রণা।

বাবা-মা দু’জনেই কর্মব্যস্ত থাকতেন সারাদিন। তবে তাতে অসুবিধা হয়নি খুব একটা শিশু উইলিয়ামের বিকাশে। পড়তে শেখা নিজের উদ্যোগেই। ভাষার দখল এতটাই ছিল যে মাত্র ১৮ মাস বয়সে উইলিয়াম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পড়ে যেতে পারতেন এক নাগাড়ে। ৮ বছর বয়সের মধ্যে আয়ত্ত করেছিলেন আটটি ভাষা। যার মধ্যে রয়েছে— ল্যাটিন, গ্রিক, ফরাসি, রাশিয়ান, হিব্রু, তুর্কি এবং আর্মেনিয়ান। শুধু তাই নয়, নিজেও একটি পৃথক ভাষা তৈরি করে ফেলেছিলেন উইলিয়াম সিডিস। ‘ভেল্ডারগড’ নামে পরিচিত সেই ভাষার শব্দ থেকে শুরু করে ব্যাকরণ সবটাই তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত।

১৯০৭ সাল। তাঁর বয়স তখন মাত্র ৯ বছর। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নাম লিখিয়ে এলেন তাঁর বাবা। প্রবেশিকাতে পাশ করে গেলেও ৯ বছর বয়সী শিশুকে শিক্ষার্থী হিসাবে ভর্তি নিতে চায়নি পৃথিবীর এই প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়। তবে সেই সুযোগটা নিজেই করে নেন উইলিয়াম। ২ বছর পরে আবারও প্রবেশিকায় নিজেকে প্রমাণ করেন তিনি। ১৯০৯ সালে তাঁকে আর প্রত্যাখ্যান করতে পারেনি ইনস্টিটিউট। তিনিই এখনও পর্যন্ত হাভার্ডে ভর্তি হওয়া সব থেকে কমবয়সি শিক্ষার্থী। 

সেসময় উইলিয়ামের বুদ্ধিমত্তায় চমকে গিয়েছিলেন হাভার্ডের তাবড় গণিতবিদরাও। মাত্র এক বছরের মধ্যে গণিতে বক্তৃতা দেওয়া শুরু করেন তিনি। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়েই। সেটা ১৯১০ সাল। উইলিয়ামের এই কৃতিত্ব ছড়িয়ে পড়ল সারা মার্কিন প্রদেশে। ধারাবাহিকভাবে লেখালিখি চলতে থাকল মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলিতে। 

তবে সাধারণের মধ্যে উইলিয়ামকে নিয়ে এতটাই মাদকতা তৈরি হয়ে ছিল, যে রাস্তায় বেরনোও তাঁর পক্ষে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। খানিক মুখচোরা স্বভাবের হওয়ায় একাকিত্বকেই বেছে নেন তিনি। এই খ্যাতি এতটাই ক্লান্তিকর ছিল তাঁর কাছে যে, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

আরও পড়ুন
আইকিউ আইনস্টাইনের প্রায় দেড় গুণ, বিস্মৃতির অতলে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান ব্যক্তিত্ব

ঠিক এই জায়গাতেই উইলিয়ামের সংঘাত লাগে তাঁর বাবার সঙ্গে। তাঁর বাবা চেয়েছিলেন তিনিও যেন প্রতিভাধর মনোবিজ্ঞানী হয়ে ওঠেন। বাবার অমতে গিয়েই বাড়ি ছেড়েছিলেন উইলিয়াম। সেই দ্বন্দ্ব এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে, ১৯৩৩ সালে বাবার মৃত্যুর সময় শেষকৃত্যেও যাননি উইলিয়াম। 

বাড়ি ছাড়ার পর উইলিয়াম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিবাদ করে অংশ নেন একাধিক মিছিলে। লিখতে থাকেন সমাজতন্ত্রের ওপর একাধিক বই। ১৯১৯ সালে তাঁর এই সক্রিয়তার জন্যই গ্রেপ্তার হতে হয় পুলিশের কাছে। টানা ১৮ মাস জেলে থাকতে হয়েছে তাঁকে। 

জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ‘লো প্রোফাইল’ স্ট্যাটাস বজায় রাখতে স্বল্প বেতনের কেরানির চাকরি নিলেন এক মার্কিন অফিসে। তবে খুব বেশিদিন লুকিয়ে থাকা গেল না। ১৯২৪ সালে আবার সংবাদের শীর্ষে চলে এলেন উইলিয়াম। ‘মাত্র ২৩ ডলার মাসিন বেতনে কাজ করছেন বিশ্বের সবথেকে বুদ্ধিমান ব্যক্তি’— এমনটাই ছাপা হয়েছিল তৎকালীন খবরের কাগজগুলিতে। যে উইলিয়ামকে নিয়ে একসময় মাদকতা ছড়িয়ে পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে এবার তাঁকে নিয়েই শুরু হল সমালোচনা, হাসি-ঠাট্টা। রটে গেল নিজের বুদ্ধিমত্তার দক্ষতা হারিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন
কী ছিল আইনস্টাইনের শেষ উচ্চারণ? আজও রহস্য হয়েই থেকে গেছে সে-অধ্যায়

তবে সত্যিই কি নিজের ক্ষমতা হারিয়েছিলেন? উত্তর একেবারেই নয়। ছদ্মনাম নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু বই লিখেছেন তিনি পরবর্তী অজ্ঞাতবাসে। জীবনধারণের জন্য কাজ করেছেন শ্রমিকেরও। ১৯৪৪ সালে বিশ্বের অন্যতম সেরা এই ব্যক্তিত্ব মাত্র ৪৬ বছর বয়সেই বিদায় নেন পৃথিবী থেকে। আশ্চর্যের বিষয়, মৃত্যুর কারণ ছিল ব্রেন হেমারেজ। সারা বিশ্বকে বদলে দিতে পারার ক্ষমতা ছিল যাঁর মধ্যে এভাবেই বিদায় নিতে হয়েছিল তাঁকে। এ যেন এক অদ্ভুত উপাখ্যান…

Powered by Froala Editor

More From Author See More