সম্মান নেই ব্যবসায়, সময়ের দৌড়ে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছেন ‘ব্যান্ড পার্টি’র শিল্পীরা

‘মেহবুব ব্যান্ড’-এর প্রতিষ্ঠাতা মেহবুব। ‘ন্যাশানাল ব্যান্ড’-এ প্রথম থেকে কাজ করে অবশেষে বছর দশেক হল নিজেই একটা দল গড়ে তুলেছেন। মহাত্মা গান্ধী রোডের ধারে ছোট্ট ঘরের চারিদিকে সাজানো ড্রাম, স্যাক্সোফোন। সাজানো আছে বাদকদের সাজ-পোশাকও। শুধু মেহবুব নেই। পাশের চায়ের দোকান থেকে একটি ছেলে চা দিতে এসে বলে গেল, মেহবুব আসছেন। আরও মিনিট দশেক পর তিনি যখন এলেন তখন মেঘলা দিনেও তাঁর সারা শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। এসেই বললেন, “আমার অনেকটা দেরি হয়ে গেল। আপনি চলে যাননি, তার জন্য ধন্যবাদ। কেউ তো খোঁজ নেয় না আমাদের। আমরাও চাই মানুষ জানুক আমরা কেমন আছি।” কথায় কথায় জানা গেল, পাশের ফল পট্টিতে ফলের ভ্যান চালাতে গিয়ে দেরি হয়ে গিয়েছে মেহবুবের। সময়মতো পৌঁছে দিতে না পারলে ১০০ টাকা হাতছাড়া হয়ে যেত।

তিন পুরুষ ধরে ব্যান্ড পার্টির সঙ্গেই জড়িয়ে মেহবুবের পরিবার। হাতে কলম তোলার অনেক আগেই তুলে নিয়েছেন ড্রামের স্টিক। “অবস্থা আগের থেকে অনেক খারাপ হয়েছে। কিন্তু কখনও ভাবিনি অন্য কাজ করতে হবে। এই করোনা এসে সব কেমন হয়ে গেল। এখন তো ভ্যান না চালালে পেট চলবে না।” মেহবুবকে নিজেকেই এখন জীবিকার জন্য অন্য পথ ধরতে হচ্ছে। অথচ কিছুদিন আগেও তাঁর অধীনের কাজ করতেন জনা ২০ কর্মচারী। তাঁরাও একইরকমভাবে অন্য পেশার দিকে চলে গিয়েছেন। কেউ কেউ গ্রামে চলে গিয়েছেন। কেউ আবার শহরেই মজুরের কাজ করছেন। “সরকার যখন জানাল যে দুর্গাপুজো হবে, তখন অনেকটা আনন্দ হয়েছিল। ভেবেছিলাম, বিসর্জনের সময় তো আমাদের ডাক পড়বেই। কিন্তু সরকার সবার কথাই ভাবল, শুধু আমাদের কথাটাই না। বিসর্জনটাই বন্ধ হয়ে গেল।” বলছিলেন ‘বেঙ্গল ব্যান্ড’-এর মহম্মদ নাদিম।

বিয়েবাড়ি বা ঘরোয়া অনুষ্ঠানেও এখন আর তেমন ডাক আসে না। আর এই মহামারী পরিস্থিতিতে যখন কোনো অনুষ্ঠানেই ১০০ জনের বেশি প্রবেশাধিকার নেই, তখন আর ব্যান্ড পার্টির ডাক আসবেই বা কীভাবে? দুর্গাপুজোর সময় ব্যান্ড পার্টির ডাক পড়ে মূলত বিসর্জনের শোভাযাত্রাতেই। সেই শোভাযাত্রা বন্ধ ঘোষণা হয়েছে আগেই। একমাত্র কিছু ক্ষেত্রে মণ্ডপের মধ্যে বাজনার আসর বসে। সোমবার হাইকোর্টের রায়ে সেই সম্ভাবনাও খারিজ হয়ে গেল। মহম্মদ নাদিম অবশ্য বলছেন, “এতে তেমন আশ্চর্য হওয়ার আর কিছু নেই। এমনিতেও আমাদের কোনো ডাক আসেনি এ-বছর।” তবে আদালতের রায়ে যে তিনি হতাশ, সেটা বোঝা গেল তাঁর পরের কথাগুলো থেকেই। “আমরা যে ব্যবসা করি, সেটা নিয়ে কেউ ভাবে নাকি? এই তো কিছুদিন আগে পৌরসভার কাছে গিয়েছিলাম ছোটো পুঁজির ব্যবসা হিসাবে এই পরিস্থিতিতে কিছু সরকারি সাহায্য চাইতে। তো আমাদের বলে দিল, ব্যান্ড পার্টি আবার ব্যবসা নাকি! কেন? আমরা কি ট্যাক্স দিই না? আমাদের কি রেজিস্ট্রেশন হয় না?”

কলকাতায় ব্যান্ড পার্টি বললেই মনে আসে মহাত্মা গান্ধী রোডের নাম। ঠিক কলেজ স্ট্রিটের মোড় থেকে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ ক্রসিং পর্যন্ত রাস্তার ডানদিকে পরপর অসংখ্য দোকান। মার্চ মাসের আগে পর্যন্ত সেখানে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই কানে আসত ড্রাম বা স্যাক্সফোনের আওয়াজ। এখন সবটাই থমকে গিয়েছে। থমকে গিয়েছে প্রতিটা মানুষের জীবনও। ‘ভারত ব্যান্ড’-এর মহম্মদ ফারুক তো জানালেন, পয়সার অভাবে তাঁর দুই ছেলেকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিতে হয়েছে। অনলাইনে ক্লাস করার সামর্থ্য ছিল, কিন্তু সমস্ত সঞ্চয় শেষ করেও স্কুলের বেতন দিতে পারেননি। আবার কবে ছেলেরা স্কুলে যেতে পারবে, জানেন না তিনি। তবে মানুষের রুচিও বদলাচ্ছে। এই মহামারী পরিস্থিতি চলে গেলেও সুস্থ জীবনে ফিরতে পারবেন কিনা, সে-বিষয়ে নিশ্চিত নন কেউই। এই সময় সামান্য একটু সাহায্যই তাঁদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারে।

আরও পড়ুন
দিন ফুরিয়েছে আতরের, শতবর্ষের স্মৃতি আঁকড়ে ধুঁকছে কলকাতার ‘গুপ্ত পারফিউমার্স’

Powered by Froala Editor

More From Author See More