আকাশবাণীর সম্প্রচারে ‘অচেনা’ সেই রেকর্ডিং-ই; কতটা আলাদা ১৯৬৬-র মহিষাসুরমর্দিনী?

মহালয়ার ভোর। বেতারে ঘোষণা- “বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান সংগীতবীথী ‘মহিষাসুরমর্দিনী…’  তারপর তিনবার শঙ্খধ্বনি। এরপর আসবে সেই বিখ্যাত আবহ, যা এক সুরে চিনিয়ে দেয় এই অনুষ্ঠানের প্রচলিত রূপটিকে। কিন্তু না, আবহ বাজল না। শঙ্খধ্বনির সঙ্গে এল তানপুরার টান। তিনবার। ‘যা চণ্ডী মধুকৈটভাদি দৈত্যদলনী…’ স্তোত্রটি সমবেতকণ্ঠে গাওয়া হল না, একক কণ্ঠে বিলম্বিত লয়ে সেটি উচ্চারণ করলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রই। তারপর, সেই শ্লোকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে’-র চেনা ভাষ্য।

১৯৬৬ সালের রেকর্ডিং। বাজানো হয়েছিল ২০১৮ এবং ১৯-এ, এবারেও বাজানো হল তাই। তবে এবারে ছিল আগাম ঘোষণা। এই রেকর্ডিং-এ অনেক কিছুই বেশ ‘অন্যরকম’। ‘সিংহস্থা শশিশেখরা’র পর শুরু হল ‘মহামায়া সনাতনী’-র ভাষ্য-সুর কিন্তু চেনা ছকের বাইরে। সুপ্রীতি ঘোষের কণ্ঠে পরিচিত ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’ গানটির আবহ-অনুষঙ্গও কিছুটা আলাদা। খুব মন দিয়ে শুনলে ধরা পড়ে, ‘তোমারি আলোয় নিরুপম’ অংশের সুরও একটু অন্যরকম - ‘আলো-য়’ সুর খেলিয়েও রইল মোটামুটি একই পর্দায়, উঠল না। অথচ পরবর্তী ভাষ্যে ‘হে ভগবতী মহামায়া’ শুরু করলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ অপেক্ষাকৃত উঁচু পর্দায়। এই পর্বে ‘তিনি আবার বিন্ধ্যবাসিনী মহিষাসুরমর্দিনী’ অংশটি নতুন সংযোজন। ‘হে অমৃতজ্যোতি… ধরণী হোক প্রাণময়ী’ বলেই ভাষ্য শেষ। ‘জাগো জাগো মা’ বাদ। সরাসরি গান ধরে ফেললেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। ‘জাগো দুর্গা’ গানের পশ্চাৎপটেও আবহের ব্যবহার অনেক কম।

‘দেবী চণ্ডিকা সচেতন চিন্ময়ী... তিনি নিত্যা...’ পাঠের সময় দেখা যাচ্ছে, এক-একটি স্বরে অনেক বেশি ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ, স্বরের ওঠানামা খুব একটা নেই। ‘ত্বং স্বাহা, ত্বং স্বধা’ শ্লোকটির সুরও বাংলা ভাষ্যপাঠের আদলে, অনেক মৃদু সুরে - সামগ্রিক ভাবে এই রেকর্ডিং এর বৈশিষ্ট্য হল বাংলা গদ্য ও সংস্কৃতশ্লোক উচ্চারণে সুরক্ষেপণের পার্থক্য যথাসম্ভব কমিয়ে আনা।

দেবীর আবির্ভাবের পর ‘গগনে গগনে নিনাদিত হল মহাশঙ্খ’, কিন্তু আবহে শাঁখ বাজল না। ‘...ঋক্-মন্ত্রে ঘোষণা করলেন আত্মপরিচয়’-এর পর আরও একটি বাক্য- “তিনিই সচ্চিদানন্দ স্বরূপ, সর্ব গত পরমাত্মার সঙ্গে নিজ আত্মার অভেদ সমাধিবলে উপলব্ধি করে আপনাকে সকল জগতের অধিষ্ঠানে আধাররূপ কল্পনায় স্বীয় আত্মারই স্তুতি করলেন”- যা প্রচলিত রেকর্ডিং-এ নেই। আরও অভিনবত্ব এল ঠিক এর পরেই ‘অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যহম্’ স্তোত্রগানে- এটিতে মূলত নারীকণ্ঠের প্রাধান্য শুনি আমরা। কিন্তু এইবারের রেকর্ডিং-এ পুরুষকণ্ঠ অনেকটাই স্পষ্ট শোনা যায়। এই সূক্তে দেবী বলছেন- তিনি পুরুষ, প্রকৃতি সব কিছুর মধ্যেই ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন। তাই কি এই অসমতা কমিয়ে আনার চেষ্টা? আর এই তাত্ত্বিক বক্তব্য তুলে ধরার জন্যই কি ওই অতিরিক্ত বাক্যটি রাখা হয়েছে ভাষ্য পাঠে? সূক্তটি গাওয়াও হয়েছে কিছুটা ধীর লয়ে, এবং তার পরে কোন বিরতি নেই। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভাষ্য পাঠ ধরেছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ।

আরও পড়ুন
মহালয়া ছিল পিতৃতর্পণের তিথি, মহিষাসুরমর্দিনীর হাত ধরে নবজন্ম দিনটির

‘মাগো তব বীণে সঙ্গীত’ গানটি বাদ গিয়েছে এই রেকর্ডিং-এ। ‘অখিল বিমানে’ গানটির মাঝের অংশে পেছনে তেমন কোনো যন্ত্র সহায়তা শোনাই যায় না, শেষের দিকে হালকা আবহ ও তালবাদ্যের আওয়াজ। ‘শুভ্র শঙ্খরবে’ গানটিতে তেমন পরিবর্তন নেই, তার পর আবার একটি নতুন শ্লোক- ‘অতুলং তত্তেজঃ সর্বদেব-শরীরজম্’, শ্রীশ্রীচণ্ডীর দ্বিতীয় অধ্যায় থেকেই।

দেবী যেখানে যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, বিষ্ণু দিচ্ছেন চক্র, যম কালদণ্ড… ইত্যাদি, তখনও কিন্তু ভাষ্যপাঠ পরিচিত নাটকীয়তায় চরমে উঠছে না। প্রায় স্বাভাবিক বর্ণনাভঙ্গি এবং অবশ্যই, মানানসই গাম্ভীর্য বজায় রেখেছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। যেখানে প্রয়োজন, নাটকীয়তা আসছে শুধু কণ্ঠে- আবহ-নির্ভরতায় নয় । প্রচলিত রেকর্ডিং-এ শ্রোতাদের সামনে যুদ্ধের দৃশ্য ‘দেখানো’র ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মনে হয়, আর এই রেকর্ডিং-এ ‘শোনানো’র ওপর। ‘রণদুন্দুভিধ্বনিতে অখিল সংসার নিনাদিত হল’ যখন বলা হচ্ছে তখন নেপথ্যে যুদ্ধের আবহ বাজল না, কিন্তু “…অভিবন্দনা” উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে জনতার উল্লাসধ্বনি জাতীয় এক ধরনের ‘ন্যাচারাল’ আবহ শোনা গেল।

আরও পড়ুন
পৌঁছতে পারেননি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ, আকাশবাণীতে সেবার স্তোত্রপাঠের দায়িত্বে নাজির আহমদ?

‘নম চণ্ডী, নম চণ্ডী’ গানটির সুর শুনে চমক লাগে আবার। মীড় ছেঁটে দিয়ে, টান কমিয়ে কেমন যেন মার্চিং সুর। আবার যুদ্ধ আরম্ভের সময় ঝড়-তাণ্ডবের সেই পরিচিত আবহ নেই, ‘গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ়’ অনেকটা স্নিগ্ধ ভঙ্গিতে উচ্চারিত। মনে হচ্ছে যেন যুদ্ধ অনেক আগে ঘটে গেছে, এখন শান্ত পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে দার্শনিক নির্লিপ্তি সহ সেই যুদ্ধের বিবরণ শুনছি আমরা। ১৯৬৬-র রেকর্ডিং নস্টালজিয়ায়, আবেগে যত না ভাসায়, তার চেয়ে অনেক বেশি ভাবিয়ে তোলে। পরিচিত ভঙ্গি, শোনার অভ্যাসকে প্রশ্ন করতে শেখায় বার বার।

আরও আছে পরিবর্তন। ‘দেবি চণ্ডিকা, তোমার পুণ্য স্তবগাথা’ অনেক নিচু পর্দায় শুরু হল, আবার ‘দেবি প্রপন্নার্তি’ শ্লোকপাঠ হল মুক্তছন্দে। ‘সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে’ থেকে আবার পুরনো ছন্দে ফেরা। ‘রোগানশেষানপহংসি তুষ্টা…’ আবার প্রায় বাংলা ভাষ্যের সুরে বলা। ‘বিমানে বিমানে’র পর কোন বিরতি ছাড়াই ভাষ্যপাঠ শুরু; জয় জয় জপ্যজয়ে’র আগে একটু তালবাদ্য নতুন রকমের লাগল। ‘হে চিন্ময়ী…’ গানটি গাওয়া হল দ্রুতলয়ে। তারপর আবার নতুন ভাষ্য- “এই তপ্তকাঞ্চনবর্ণা মহিষাসুরমর্দিনী… যুগে যুগে সুভাষিত”। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘তব অচিন্ত্য রূপচরিত মহিমা’ বিখ্যাত হয়েছে তার বহুল-রাগপ্রধান, কালোয়াতি সুরের জন্য। কিন্তু এই রেকর্ডিং-এ গিটকিরি ও খটকার প্রয়োগ কিছুটা কম, উচ্চারণ অনেকটা সংস্কৃতের মত। এই রেকর্ডিং-এ গানটি রয়েছে শেষের দিকে। এর পর “শ্রীশ্রী চণ্ডিকা অখিল বিশ্বের প্রকৃতি স্বরূপিণী...চতুর্বর্গ লাভ করে মর্ত্যলোক’- ভাষ্যের পর একটি নতুন গান, সমবেত কণ্ঠে- ‘জ্ঞানপূর্ণসম শিখরিণী’।

আরও পড়ুন
বৃষ্টিভেজা শ্রাবণে প্রয়াত রবীন্দ্রনাথ, শেষযাত্রার ধারাবিবরণী দিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজকুমার মল্লিক, বাণীকুমারের মত ‘নব নব উন্মেষশালিনী’ প্রতিভা নিজেদের সৃষ্টি নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দ্বিধা করেননি। ঐতিহ্যের সঙ্গে কিন্তু গতানুগতিকতার কোন বাধ্য বাধকতার সম্পর্ক নেই। তাই বারবার বদলেছে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। ১৯৬২ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার রেকর্ডিং হয়েছে। পাল্টেছে ভাষ্য ও গানের কথা, আগে-পরে করা হয়েছে গান, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বদলেছেন শিল্পীরাও। সংযোজন-বিয়োজন সবই ঘটেছে শিল্পের পরিবেশনায় নতুনত্বের খাতিরে। ১৯৬৬-র রেকর্ডিং এই ধারার একটি নিদর্শন মাত্র। এমন দুর্লভ রেকর্ডিং-এর সম্ভার কিন্তু আরও রয়েছে আকাশবাণীর সংগ্রহে। সে সব আমাদের শোনার সৌভাগ্য আজও হয়নি।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
নব্বইয়ের মহালয়া, রেডিও নয় তবু নস্টালজিয়া