মোষের মাংস থেকে টমেটো-পোস্তর চাটনি— বাংলার লুপ্তপ্রায় পদ নিয়ে হাজির আমতলার শিক্ষক

 “হাজি সাহেব, আমেনিয়া, আর্সালান আপনাকে বিরিয়ানি খাওয়াবে। কিন্তু তাহিরি, নারকেল ভাত, জর্দা ভাত— এগুলো তারা দেবে না। রুমালি রুটি, লাচ্চা পরোটা খাওয়াবে কিন্তু জালি পরোটা খাওয়াবে না। লোকোপুরের বাটা মাছ ভাজা, দেশি মুরগির ডিম, মোষের মাংস খাওয়াবে না। আর সেই জন্যই আমার এই উদ্যোগ…”

বলছিলেন পিনাকী গুহ। পেশায় শিক্ষক। দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার আমতলার পীরতলা উচ্চ বিদ্যালয়ে বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই শিক্ষকতা করছেন তিনি। কিন্তু শুধু এটুকু তাঁর পরিচয় দেওয়া হয়ে ওঠে না সম্পূর্ণভাবে। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের হারিয়ে যেতে বসা সংস্কৃতির অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। নিয়েছেন সেসব সংরক্ষণের অদ্ভুত এক উদ্যোগও।

কোনো একটা অঞ্চলের সংস্কৃতি বা ‘রিচুয়াল’-এর প্রসঙ্গ উঠলেই প্রত্যেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই অঞ্চলের মানুষের ভাষা, সাহিত্য, হস্তশিল্প, সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব নিয়ে। কিন্তু ঐতিহ্যের চরিত্র কি এইটুকু পরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ? তা একেবারেই নয়! বরং কোনো অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাসের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে সংস্কৃতি কিংবা ইতিহাসের একটি বড়ো অংশ। তার সঙ্গে কখনো কখনো জড়িত থাকে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানও। আর ঠিক সেই জায়গাটাতেই প্রতিনিয়ত অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন পিনাকীবাবু। প্রান্তিক বাংলা থেকে তুলে আনছেন বিভিন্ন ‘অবলুপ্ত’ হতে বসা খাদ্যপ্রণালীকে।

আরও পড়ুন
স্বাদে-সৌন্দর্যে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল; ঐতিহ্যবাহী গয়না বড়ি এবার আপনার নাগালেও

“আমার এক ভাগ্নির ছেলে মুখেভাতে খেয়েছি অসম্ভব একটা ভালো চাটনি। সাধারণ টমেটোর চাটনিই। কিন্তু তাতে চিনির বদলে গুড় দেওয়া। সেইসঙ্গে পোস্তো ভাজা ব্যবহার করা হয়েছে তাতে। ভজহরি মান্না, ১৩ পার্বন— এই ধরণের রেস্তোরাঁগুলো যেখানে বাঙালি খাবার পাওয়া যায় তাঁরাও তো এমন পদ করে না। এটা জানতে গেলে কোনো একটা জায়গার অঞ্চলিক ইতিহাস এবং সংস্কৃতিকে তলিয়ে দেখতে হয়”, বলছিলেন পিনাকীবাবু।

তবে শুধুই কি বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পদের অনুসন্ধান? না, সেখানেই থেমে নেই তিনি। বরং সেসব পদের অনুসন্ধানের পর, তাঁদের রন্ধনপ্রণালী শিখে তা নিজেই বাড়িতে সফলভাবে তৈরি করছেন পিনাকীবাবু। কোনো রেস্তোরাঁ নয়, বরং নিজেই বিভিন্ন প্রিপেড পপ-আপ আয়োজন করে সেসব পদ খাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন বাঙালিকে।

আরও পড়ুন
স্টিমার যাত্রা, গোয়ালন্দ চিকেন কারি ও দেশভাগের স্মৃতি

গত ৪ মার্চ, এমনই একটি পপ-আপ আয়োজন করেছিলেন তিনি কলকাতার উপকণ্ঠে দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায়। আর প্রথম পদক্ষেপেই এসেছে অভাবনীয় সাফল্য। বাণিজ্যিকভাবে এই পপ-আপ শুরু করার পরিকল্পনা থাকলেও এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ গতি পায়নি সেই উদ্যোগ। তবে খুব তাড়াতাড়িই যে সেসব আসতে চলছে, তারই ইঙ্গিত দিলেন পিনাকীবাবু। 

আরও পড়ুন
গোয়ালন্দ ঘাট, পদ্মার স্টিমার ও এক ‘গোপন’ মুরগির রেসিপির গল্প

আশ্চর্যের বিষয় হল, এই সব পপ-আপে প্রতিটি পদই হবে অনন্য। প্রতিটি পদই গ্রামবাংলার বিভিন্ন লোকসংস্কৃতি থেকে তুলে আনা। আর সেই পরিষেবা পাওয়া যাবে খোদ কলকাতা শহর কিংবা কলকাতারই উপকণ্ঠে অবস্থিত দক্ষিণ ২৪ পরগণা কিংবা হাওড়ায়। তবে সংশ্লিষ্ট অঞ্চল থেকেই নিয়ে আসা হবে রন্ধনশিল্পীদের। “ওদের আমি সবসময় বলি, কলকাতাকে নকল করতে যেও না। লোকে বিরিয়ানি খেতে তোমাদের কাছে আসবে কেন? তোমরা যেটা পারো, যে জিনিসটা তোমাদের কালচার, সেটা উপস্থাপনা করো। আসলে আন্তর্জাতিকতার কাছে উপহার আমার আঞ্চলিকতাই”, জানালেন পিনাকী গুহ। 

উত্তেজনা সামলাতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসা গেল, কী কী পদ থাকছে আগামী পপ-আপগুলোর মেনুতে। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন বছর চল্লিশের শিক্ষক, “অনেকের বাড়িতে দীপান্বিতা পুজোয় অসম্ভব ভালো ভোগ রান্না হয়। বা ধরুন রান্নাপুজোর ভোগ কিংবা দুর্গাপুজোর অষ্টমীর ভোগ— এই ধরণের বিশেষ অনুষ্ঠানে বিশেষ আঞ্চলিক পদ পাওয়া যাবে পপ-আপে। যেগুলো কোনো রেস্তোরাঁতে তো বটেই বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া গ্রামবাংলাও প্রস্তুত করা হয় না। কাঁকিনাড়ায় একটা মিষ্টি খেয়েছিলাম। নরম পাকের সন্দেশ এবং রসগোল্লা। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি ওই স্বাদ গাঙ্গুরাম, কেসি দাস, মিঠাই, বাঞ্ছারাম কোথাওই পাবেন না। এঁদের গুণমান নিয়ে কোনোভাবেই সন্দেহ নেই। কিন্তু ওই স্বাদ বাংলার আর কোনো জায়গাতেই পাওয়া যাবে না। আমার কাছে এলে মাজা, স্লাইস কিংবা অন্যান্য কোল্ড ড্রিঙ্কস নয় বরং বাতাসাগুঁড়ো আর ডাবের জল দিয়েই আপ্যায়ন জানাব অতিথিদের।”

কিন্তু এমন একটি দারুণ উদ্যোগ সত্ত্বেও রেস্তোরাঁ দিকে হাঁটছেন না কেন তিনি? উত্তরে পিনাকীবাবু জানালেন, “রেস্তোরাঁ তৈরির খরচের পাশাপাশি আরও একটা বিষয় রয়েছে। তা হল সাধারণ মানুষের মতামত। তাঁরা আমার সামনে থেকে খাবারের গুণমান সম্পর্কে ফিডব্যাক দিতে পারবেন না। যেটা জানতেই আমার বহুদিন সময় লেগে যাবে। আর তার থেকেও বড়ো কথা এই পপ-আপের মাধ্যমে তাঁদের কোনো একটি সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে পরিচয় করানো সম্ভব।”

পিনাকীবাবু জানালেন, আগামী দিনে সামাজিক মাধ্যমেই তিনি মানুষকে আগাম জানাবেন এই পপ-আপগুলোর সম্পর্কে। যোগাযোগ করে শুধুমাত্র বুক করে নিতে হবে। রসনার তৃপ্তির দিকটা দায়িত্ব নিয়ে নিজেই সম্পন্ন করবেন তিনি। 

তবে এইটুকু বললেই শেষ হয় না পিনাকীবাবু সম্পর্কে। শুধু গ্রামবাংলারই রন্ধনপদ নয়, রাশিয়া কিংবা ভিনদেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক পদও রপ্ত করেছেন তিনি। বিস্ময় দেখে হেসে ফেললেন পিনাকীবাবু, “মধু আর আদা দিয়ে তৈরি রাশিয়ান কুকি তৈরি করেছিলাম। যেটা ওরা সামওভার থেকে ঢালা চায়ের সঙ্গে খায়। এটা গতবছরের কথা। কিন্তু তারপরেই লকডাউন হয়ে গেল। তারপর আর এই রেসিপি নিয়ে সেভাবে ভাবা হয়নি।”

রন্ধনশিল্পের পাশাপাশি হস্তশিল্প নিয়েও যথেষ্ট চর্চা করে চলেছেন তিনি। বাংলার আরও একটি অবলুপ্তপ্রায় সাংস্কৃতিক ‘অধ্যায়’ কাঁথা নিয়েই অভিনব এক উদ্যোগ নিয়েছেন পিনাকীবাবু। নিজে সেই বুননের সমর্থ হয়েও দক্ষ শিল্পীদের দিয়ে প্রস্তুত করাচ্ছেন বিভিন্ন ঘরানার কাঁথা। অর্ডার আসছে পরিচিত অনেকেরই থেকেই। সাধারণ কাঁথার থেকে দাম খানিকটা বেশিই পড়ছে তাতে। লুকোছাপা না রেখেই জানালেন, খানিকটা লভ্যাংশ রেখেই এই উদ্যোগ। তবে সে লাভের বিন্দুমাত্র নিজের পকেটস্থ করেননি পিনাকীবাবু, “শিক্ষকতা করি বলেই এক্ষুনি এই লাভের প্রয়োজন পড়ছে না। কাজেই যে লাভটা হচ্ছে সেটা সম্পূর্ণভাবে তুলে দিচ্ছি শিল্পীদের হাতে। পড়ে নিশ্চয়ই দরকার লাগতে পারে। তখন বাণিজ্যিকভাবে ভাবা যাবে নয়…”

বাঙালির রন্ধন পদই হোক কিংবা কাঁথাশিল্প— পিনাকীবাবুর এই অভিনব উদ্যোগ যে শুধু এইসব মৃতপ্রায় সংস্কৃতিদের বাঁচিয়ে রাখার মন্ত্র হয়ে উঠেছে তেমনটা নয়। তাঁর সঙ্গে যেমন পরিচিত হচ্ছেন খাস কলকাতার ‘বাবু’-রা; তেমনই সেখান থেকে উপার্জনের ক্ষীণ পথেরও হদিশ পাচ্ছেন প্রান্তিক শিল্পীরা। আর এই উদ্যোগের সাফল্যে যে আগামীতে স্থায়ী আয়ের হদিশ যোগাবে তাঁদের, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। জানি, এসব শুনে লোভ সামলানো খুব একটা সহজ কাজ নয়। তবে আর কী? সুযোগ বুঝে একদিন হাজির হয়ে পড়ুন পিনাকীবাবুর এই অসাধারণ উদ্যোগে। প্রথমবারের জন্য চেখেই দেখুন না মোষের মাংস কিংবা দীপান্বিতা পুজোর ঐতিহ্যবাহী প্রসাদ…

Powered by Froala Editor