টেক্সাস স্টেটে নিষিদ্ধ গর্ভপাত, বিতর্কের ঝড় আমেরিকার অন্যত্রও

বেশ কয়েক বছর ধরে জটিলতা চলছিলই। বিতর্ক জমা হচ্ছিল বিভিন্ন স্তরে। শেষ পর্যন্ত ২০২১ সাল এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ হয়ে হাজির হল আমেরিকার সামনে। আলোচনার কেন্দ্রে গর্ভপাত সংক্রান্ত আইন। সম্প্রতি টেক্সাস স্টেট আদালতের রায়ে জানানো হয়েছে কোনো ভ্রূণের হৃদস্পন্দন শুরু হয়ে গেলে আর গর্ভপাত করা যাবে না। স্বাভাবিকভাবে যে ঘটনাটি ঘটে গর্ভধারণের ৬ সপ্তাহের মধ্যে। যে সময়ের আগে মহিলারা নিজেদের মাতৃত্ব সম্পর্কে অবগত হতেই পারেন না। অর্থাৎ কার্যত ১৯৭৩ সালে রু-ওয়াদেন মামলার সূত্রে গর্ভপাতকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার যে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট, তাতেই ইতিরেখা টানল টেক্সাস। আর এই সিদ্ধান্তের পরেই উঠে আসছে আমেরিকার অন্যান্য স্টেটগুলির কথাও। ভাবতে অবাক লাগে, একুশ শতকে এসেও আমেরিকা জুড়ে জাঁকিয়ে বসে আছে মাতৃত্ব সংক্রান্ত নানা কুসংস্কার ও গোঁড়ামি।

শুধুই টেক্সাস নয়, মার্কিন আইন বিষয়ক পত্রিকাগুলির পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২১ সালে আমেরিকার ১৫টি স্টেটে গর্ভপাত সংক্রান্ত আইন কঠোর করা হয়েছে। আর সব মিলিয়ে অন্তত ৭০ ধরনের নিষেধাজ্ঞা লাগু হয়েছে মাত্র ৫ মাসের মধ্যে। মিসিসিপি ও লুসিয়ানা স্টেটে ইতিমধ্যে  মামলা প্রায় নিষ্পত্তির পথে। সেখানেও ১৫ সপ্তাহের পর গর্ভপাত নিষিদ্ধ ঘোষণা হবে, এটা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। একইভাবে আরকানসাস স্টেটে কিছু চিকিৎসাজনিত সমস্যা বাদে সমস্ত ধরণের গর্ভপাত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সময়ের কোনো সীমানাও নেই। কার্যত পরিবার পরিকল্পনার যে ধারণা বিশ্বায়ণের সূত্রে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতেও গড়ে উঠেছে, তার থেকেই পিছু হঠতে শুরু করেছে আমেরিকা। শুধুই আদালতে নয়, ইতিমধ্যে গর্ভপাত বিরোধী বেশ কিছু সংগঠন তৈরি হয়েছে। তাদের প্রচার আন্দোলনও বেশ কিছু ক্ষেত্রে জঙ্গি চেহারা নিচ্ছে। পাশাপাশি বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের সংখ্যাটাও নেহাৎ কম নয়। গর্ভপাতের অধিকারের দাবিতে ইতিমধ্যে পথে নেমেছেন লক্ষ লক্ষ মহিলা।

মাতৃগর্ভে একটি ভ্রূণ থেকে পূর্ণাঙ্গ শিশুর জন্ম হতে সময় লাগে অন্তত ২৮ সপ্তাহ। এরপর সেই শিশু মাতৃগর্ভের বাইরেও বেঁচে থাকতে পারে। চিকিৎসকদের মতে, এই সময় থেকেই তাকে একটি সম্পূর্ণ নতুন জীবন হিসাবে গ্রহণ করা যায়। তবে তার আগে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে তিনটি স্তরে ভ্রূণের বিকাশ চলতে থাকে। এই পর্যায়কে পৃথক জীবন হিসাবে গ্রহণ করা হবে কিনা, তাই নিয়েই শুরু হয়েছে বিতর্ক। পাশাপাশি উঠে আসছে আরও একটি বিষয়। একটি শিশুর জন্মের পিছনে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা অবশ্যই তার মায়ের। এমনকি জন্মের পরেও মাতৃত্বের দায়িত্বই চূড়ান্ত। সেখানে একজন মহিলার অনিচ্ছার সত্ত্বেও তাঁর উপর মাতৃত্বের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার কি রাষ্ট্রের সত্যিই আছে?

এই বিতর্ক অবশ্য আজকের নয়। বিগত এক দশক ধরে মার্কিন সমাজে অন্যতম চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে গর্ভপাত। এমনকি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নির্বাচনী প্রচারের একটা গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ছিল এই যে তিনি মহিলাদের গর্ভপাতের অধিকারের বিষয়টি নষ্ট হতে দেবেন না। পাশাপাশি উঠে এসেছিল আরও বেশ কিছু পরিসংখ্যান। প্রতি বছর আমেরিকায় যত মহিলা গর্ভধারণ করেন, তার একটা বড়ো অংশই নিজের ইচ্ছায় করেন না। দেশে বার্ষিক ধর্ষণের ঘটনা বরাবর ১ লক্ষের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। ধর্ষিতা মহিলাদেরও অনেকেই গর্ভধারণ করেন। এমনকি গার্হস্থ্য হিংসা থেকে শুরু করে আরও নানা ধরণের পশ্চাৎপদতায় আজও জর্জরিত আমেরিকা। ১৯৭৩ সালে গর্ভপাত আইনি স্বীকৃতি পেলে মহিলারা যেন একমুঠো মুক্ত বাতাসের অনুভব পেয়েছিলেন। ক্রমশ সেই অংশটি সংকীর্ণ হয়ে আসছে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে রিপাবলিকান রাষ্ট্রনায়কদের হাত ধরেই গর্ভপাত বিরোধী আইন তৈরি হচ্ছে। তাহলে কি পুরোটাই হয়ে উঠছে ডেমোক্র্যাটিক এবং রিপাবলিকানদের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের অংশ? যদি তাই হয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের হস্তক্ষেপ এই মুহূর্তে ভীষণভাবে প্রয়োজন বলেই মনে করছেন মার্কিন মহিলারা।

আরও পড়ুন
মা-হারা শিশুদের মুখে মাতৃদুগ্ধ পৌঁছে দিতে উদ্যোগ দুই বাঙালিনীর

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
অন্তঃসত্ত্বা মায়ের টিকাতেই অনাক্রম্যতা সদ্যোজাত শিশুর