বিষ্ণুপুর ঘরানার ‘শেষ’ কিংবদন্তি, সঙ্গীতের পাশাপাশি ডুবে ছিলেন গবেষণাতেও

প্রায় ছ’শো বছর আগের কথা। পঞ্চাদশ শতকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল বিষ্ণুপুরের সঙ্গীতচর্চার এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। ধ্রুপদকে কেন্দ্র করেই জন্ম নিয়েছিল বাংলার একমাত্র নিজস্ব শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ঘরানা। বিষ্ণুপুর ঘরানা। বাঁকুড়ার এই ধ্রুপদ সঙ্গীতের ধারক ও বাহক ছিলেন ডঃ দেবব্রত সিংহ ঠাকুর। ছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার একনিষ্ঠ উপাসক। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি ভুগছিলেন বার্ধক্যজনিত অসুখে। গত পরশু থেমে গেল তাঁর কণ্ঠস্বর। বিষ্ণুপুর রাজবাড়িতেই ৮৩ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন গবেষক তথা কিংবদন্তি এই সঙ্গীতশিল্পী।

১৯৩৮ সালে জয়পুরের কুচিয়াকোল রাজবাড়িতে জন্ম ডঃ দেবব্রত সিংহ ঠাকুরের। বছরের পর বছর ধরে বাঁকুড়ার মল্লরাজারাই পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছেন বিষ্ণুপুর ঘরানার। ফলত, ছোট থেকেই এক সঙ্গীতচর্চার পরিবেশে বড়ো হয়ে ওঠা তাঁর। হাতে খড়ি হয়েছিল ‘সঙ্গীত সম্রাট’ গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। পরবর্তীকালে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তালিম নেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের। পাঠ নিয়েছিলেন এস্রাজ, সেতারের মতো একাধিক বাদ্যযন্ত্রের। 

তবে শুধু বিষ্ণুপুর ঘরানারই নয়, ডাগর ঘরানার ধ্রুপদ সঙ্গীতেরও পাঠ নেন তিনি। ধামার, খেয়াল, টপ্পা, ঠুমরিতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কিন্তু নিজের পরিচয় দেওয়ার সময় অগ্রাধিকার দিতেন বিষ্ণুপুর ঘরানাকে। রাজস্থানের নাথরডাহ, বেনারস, দিল্লি, হায়দ্রাবাদ, ভোপাল-সহ ভারতের অন্যতম ধ্রুপদ সঙ্গীতের কেন্দ্রগুলিতেই তিনিই উপস্থাপন করেছিলেন বিষ্ণুপুরী সঙ্গীতকে। সেইসঙ্গে সত্তর ও আশির দশকে তিনি ধারাবাহিকভাবে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন টেলিভিশন ও রেডিওতেও। 

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭০ সালে ধ্রুপদে স্নাতকত্তোর করার পর শুরু হয় তাঁর গবেষণা। বিষয় ছিল বিষ্ণুপুরী সঙ্গীতের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। ১৯৮১ সালে ডক্টরেট পান তিনি। তবে তার আগে থেকেই রামশরণ সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ে শুরু করেছিলেন অধ্যাপনার কাজ। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন সেখানকার অধ্যক্ষও। পরবর্তীতে অরুণাচল প্রদেশের ডোনি পোলো মিশন কলেজ অফ মিউজিকেও অধ্যক্ষের ভূমিকা পালন করেছেন ডঃ দেবব্রত সিংহ ঠাকুর। 

আরও পড়ুন
মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে কলকাতার সঙ্গীতশিল্পীরা, প্রকাশ পেল একের পর এক রেকর্ড

পরবর্তীকালে নিজের বাড়িতেই তৈরি করেছিলেন গোপেশ্বর মহাবিদ্যালয়। সেই মহাবিদ্যালয়ই পরে স্বীকৃতি পায় ‘ধ্রুপদ সঙ্গীত গবেষণাকেন্দ্র’ হিসাবে। তবে শেষ বয়স পর্যন্ত চাইতেন শুধুমাত্র বিষ্ণুপুর ঘরানাকে কেন্দ্র করে বাঁকুড়াতে গড়ে উঠুক আস্ত এক সঙ্গীত বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি এই আবেদন নিয়ে সরকারের দ্বারস্থও হয়েছিলেন তিনি। তবে তাঁর সেই ইচ্ছে আর বাস্তবায়িত হয়ে ওঠেনি। 

আরও পড়ুন
ভ্রাম্যমাণ ট্রাকেই সঙ্গীত পরিবেশন ভেনেজুয়েলার শিল্পীর

তবে শুধু সঙ্গীতচর্চাই নয়, বাংলার ধ্রুপদ সঙ্গীতের ইতিহাসের ওপরেও তাঁর বিস্তারিত গবেষণা বাংলা ভাষার অমূল্য সম্পদ। ‘বিষ্ণুপুর ঘরানার উৎপত্তি’, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতে বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রভাব’, ‘যদুভট্ট’-সহ তাঁর রচিত একাধিক বই-ই বাংলার সঙ্গীতচর্চার অন্যতম দলিল। তিনি স্বয়ং ছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার এক চলমান ইতিহাস। তাঁর প্রয়াণে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল বাংলার একমাত্র নিজস্ব শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ঘরানা…

আরও পড়ুন
বিষ্ণুপুরে মাটি খুঁড়তে গিয়ে উদ্ধার প্রাচীন সৌধ, লুকিয়ে কোনো অজানা ইতিহাস?

Powered by Froala Editor