অভিশপ্ত ৯/১১ : মৃত্যুমুখ থেকে কোনোমতে বেঁচে ফিরেছেন যাঁরা

/১০

১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১। চারটি বিমান ছিনতাই করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুকে আত্মঘাতী হামলা চালায় জঙ্গিরা। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারের (World Trade Centre) বুকে আঘাত করে দুটি বিমান। একটি আছড়ে পড়ে পেন্টাগনে (Pentagon)। চতুর্থ বিমানটির লক্ষ্যে আঘাত করার আগেই জঙ্গিদের সম্পর্কে জানতে পারেন বিমানের ক্যাপ্টেন। ককপিটে ধ্বস্তাধস্তির মধ্যেও তিনি পেনসিলভেনিয়ার একটি ফাঁকা মাঠে অবতরণ করান বিমানটি। তবে পরিকল্পনামাফিক তাঁর চেষ্টা সফল হয়নি। যাত্রীরা সকলেই মারা গেলেও প্রাণ বেঁচেছিল বহু মানুষের।

/১০

সব মিলিয়ে ১৯ জন জঙ্গি-সহ ২,৯৯৬ জন মানুষের প্রাণ গিয়েছিল ৯/১১ (9/11 Terrorist Attack) হামলায়। তার মধ্যে শুধুমাত্র ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার বা টুইন টাওয়ারেই মারা যান ২,৭৬৩ জন মানুষ। তাছাড়াও উদ্ধারকার্যে আটকা পড়ে প্রাণ যায় ৪০০ শতাধিক দমকলকর্মী ও পুলিশের। তবে এই নারকীয় অগ্নিকুণ্ড থেকেও রুদ্ধশ্বাস প্রাণ বেঁচেছিল বহু মানুষের। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার সেই গল্প শুনলে হাড় হিম হয়ে যায় আজও।

/১০

লরেন ম্যানিং— ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের উত্তরের টাওয়ারে সবেমাত্র প্রবেশ করেছিলেন লরেন। ঠিক তারপরেই প্রথম বিমানটি আঘাত হানে বিল্ডিংটিতে। নর্থ টাওয়ার লবিতে থাকলেও রক্ষা পাননি তিনি। উপর থেকে খসে পড়ে জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড। লোহার টুকরো ছিটকে এসে গিঁথে যায় সারা শরীরে। জ্বলন্ত অবস্থাতেই ট্রেড সেন্টারের বাইরে বেরিয়ে আসেন তিনি। ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক ব্যক্তি কোনোমতে আগুন নিভিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে পৌঁছে দেন তাঁকে। শরীরের ৮০ শতাংশ অঙ্গই ঝলসে গিয়েছিল লরেনের। বাঁচার সম্ভাবনা প্রায় ছিল না বললেই চলে। হাসপাতালে কয়েক মাস যমে-মানুষে টানাটানির পর ক্রমে সেরে ওঠেন লরেন ম্যানিং।

/১০

লিন টিরনি— লিন যখন টুইন টাওয়ারে হাজির হন, ততক্ষণে দুটি বিমানই ধ্বংসলীলা চালিয়ে ফেলেছে টুইন টাওয়ারে। নিউ ইয়র্কের দমকল বাহিনীর ডেপুটি কমিশনার লিন বুঝতে পেরেছিলেন, আগুন নেভানো তাঁদের হাতে নেই আর। আটকে পড়া মানুষদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়াই বাঁচানোর একমাত্র উপায়। সেই কাজটাই করছিলেন তিনি। ঠিক তখনই ধ্বসে পরে দক্ষিণের টাওয়ারটি। লিনের থেকে দূরত্ব ছিল মাত্র দু’ব্লক। কোনোমতে দৌড়ে জানলা থেকে ঝাঁপ দেন তিনি। দেহের একাধিক হাড় ভাঙলেও প্রাণ বেঁচে যায়।

/১০

ব্রিটন চার্লি গ্রে— মার্কিনি না হলেও ভাগ্যচক্রে সেদিন টুইন টাওয়ারে হাজির হয়েছিলেন ব্রিটিশ ট্রেডার ব্রিটন চার্লি। অবশ্য তিনি ছিলেন নর্থ টাওয়ারের ২৬ তলায়। আর বিমান আঘাত করেছিল ৮১ তলায়। টানা ২৫ মিনিটের সিঁড়ি দিয়ে নামার পর খানিক দম ফিরে পান চার্লি। ততক্ষণে দক্ষিণ টাওয়ারেও আছড়ে পড়েছে দ্বিতীয় বিমান। ভেবেছিলেন, বিপদ কেটে গেছে বুঝি। কিন্তু নিচে নামার পরেই ধ্বসে পড়ে টাওয়ারের একাংশ। টাওয়ারের আর কয়েক ফুট কাছে থাকলেও অবধারিত মৃত্যু ছিল তাঁর। তবে ভাগ্যক্রমে আঁচড়টুকুও পড়েনি চার্লির গায়ে। কিন্তু পিটিএসডিতে আক্রান্ত হন তিনি। মানসিক ট্রমা তাঁকে তাড়া করে বেরিয়েছে দীর্ঘদিন।

/১০

ডেসিরে বুচাট— প্রথম বিমানটি আছড়ে পড়ার সময়, বুচাট কর্মরত ছিলেন সাউথ টাওয়ারের ১০১ তলায় অবস্থিত এওন কর্পের অফিসে। প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছিল নর্থ টাওয়ারের ঘটনাটি নিছকই দুর্ঘটনা। তখনও অক্ষত সাউথ টাওয়ার। কিন্তু পার্শ্ববর্তী টাওয়ারে বিস্ফোরণের প্রভাব যদি এসে পড়ে তাঁদের ভবনে। এই আশঙ্কাতেই অফিস খালি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বুচাট। ১৮০ জন সহকর্মীকে নিয়ে লিফটে করে অবতরণের পর ফের ভবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলেন তিনি। সেইসময়ই দ্বিতীয় বিমানটি আঘাত করে দক্ষিণের টাওয়ারে। পরিত্রাণ মিললেও প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত হন বুচাট। পরবর্তীতে সাক্ষাৎকারে বুচাট জানিয়েছিলেন, সেসময় প্রায় চলচ্ছক্তি হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর। কোনোক্রমে আশ্রয় নেন লোডিং ডকে।

/১০

উইল জিমেনো— ট্রেড সেন্টার হামলার পর যে সব মার্কিন পুলিশকর্মী সাধারণের প্রাণ বাঁচানোর জন্য লড়েছিলেন, তাঁদের মধ্যেই অন্যতম ছিলেন উইল। টুইন টাওয়ারের দক্ষিণের ভবনটি ধ্বসে পড়ার পর, জরুরি অবস্থায় শুরু হয় উদ্ধারকার্য। আহতদের রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে আসার কাজেই লেগে পড়েন উইল। কিন্তু দক্ষিণ টাওয়ার ধ্বসে পড়ার মাত্র ২৯ মিনিটের মাথায় তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে উত্তরের ভবনটিও। উইল নিজে চাপা পড়ে যায় কংক্রিটের একটি দেওয়ালের তলায়। বাঁ পায়ে গিঁথে গিয়েছিল লোহার রড। ভয়ঙ্কররকম আহত অবস্থায় তাঁকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। প্রাণ বাঁচলেও পিটিএসডিতে আক্রান্ত হন তিনি। প্রাণে রক্ষা পাওয়ার অনুশোচনাই তাড়া করে বেড়াত তাঁকে দীর্ঘদিন।

/১০

মার্ক ডিমার্কো— উইল জিমেনোর মতোই অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছিলেন মার্কিন পুলিশ অফিসার মার্ক। মার্ক কর্মরত ছিলেন এমার্জেন্সি সার্ভিস ইউনিটে। সাউথ টাওয়ার ধ্বসে পড়ার পর জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিলেন তিনি ও তাঁর দুই সহকর্মী। যদি কোনোভাবে প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয় কারোর। নিউ ইয়র্ক তখন ঢেকে গেছে ঘন ধুলোর মেঘে। সবকিছুই দৃষ্টির আড়ালে। ফ্ল্যাশলাইট থাকা সত্ত্বেও মার্ক তাই দেখতে পাননি আস্ত একটি গহ্বর। ধ্বংসস্তূপে মধ্যে দেড় মানুষ দীর্ঘ সেই ক্র্যাটারেই পড়ে যান তিনি। খসে পড়ে কংক্রিটের চাঙর। ওই অবস্থাতেই তিনি অবরুদ্ধ ছিলেন কয়েক ঘণ্টা। তাঁর ১৪ জন সহকর্মী মারা শেষ পর্যন্ত বেঁচে ফেরেন মার্ক।

/১০

ওয়েন্ডি ল্যাঙ্কস্কি— সাউথ টাওয়ারের ২৯ তলায় অবস্থিত একটি হেলথ ইনসিওরেন্স কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন ওয়েন্ডি। দ্বিতীয় বিমান হামলার পর প্রায় মিনিট পনেরোর চেষ্টায় টাওয়ারের বাইরে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন তিনি। কিন্তু বিপদ যে কাটেনি তা কে-ই বা জানত। বাইরে বেরনোর পরই মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে পড়ে নিউ ইয়র্কের সর্বোচ্চ স্কাইস্ক্র্যাপার। দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও সারা শরীরে ছিটকে এসে বিঁধেছিল কাচের টুকরো। অ্যাম্বুলেন্স আসার আগেই প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে প্রায় নিথর হয়ে গিয়েছিলেন ওয়েন্ডি। চিকিৎসকদের তৎপরতায় শেষ অবধি প্রাণরক্ষা হয় তাঁর।

১০/১০

বিশ্বের সবথেকে ভয়াবহ জঙ্গিহানার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে এই ধরনের অজস্র গল্প। কেউ অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছিলেন নিয়তির থেকে, কেউ আবার নিজে বাঁচলেও চোখের সামনে হারিয়েছেন প্রিয়জনকে। সেসব ঘটনার সামান্যই প্রকাশ্যে এসেছে। আর বাকিরা থেকে গেছে আক্রান্তদের মধ্যে ক্ষতচিহ্ন এবং ভয়াবহতার স্মৃতি হয়ে। সেই হিসাব মেলার নয় কোনোদিনই…

Powered by Froala Editor