প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে লড়াই, কলকাতার ফুটপাথই গ্যালারি ‘ছবিওয়ালা’-র

উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে শীতের শহরে। আলোয় আলোয় সেজে উঠেছে নিউ ইয়ারের তিলোত্তমা (Kolkata)। এবার কলকাতা আরও খানিকটা রঙিন করে তুলল ‘ছবিওয়ালা’। হ্যাঁ, বাংলার চিত্রশিল্পীদের এই সংগঠনের আয়োজন করল অভিনব এক চিত্রপ্রদর্শনীর (Street Exhibition)। যেখানে ঢুকতে প্রবেশাধিকারের জন্য টিকিটের বালাই নেই কোনো। নেই ঝাঁ-চকচকে গ্যালারিও। ফুটপাথের পথচলতি মানুষই এই প্রদর্শনীর দর্শক। 

“শিল্পকে আমরাই যেন একটা বিশেষ গণ্ডির মধ্যে আটকে রেখেছিলাম। আমাদের মনে হয়েছিল এবার সেটা ভাঙতে হবে”, বলছিলেন শিল্পী তথা ‘ছবিওয়ালা’-র (Chhobiwala) অন্যতম কর্ণধার সৌরভ মিত্র। তাঁর কথায়, শিল্পের পরিসরও বৈষম্যদুষ্ট। আসলে একটি বিশেষ শ্রেণীর মানুষজন, যাঁরা শিল্পচর্চা করেন, তাঁরাই মূলত আর্ট গ্যালারিতে আসেন। কিন্তু এর বাইরেও যে বড়ো জগৎ আছে একটা। আর্থিক বা সামাজিক পরিকাঠামোই তাঁদেরকে সরিয়ে রেখেছে শিল্পের প্রাঙ্গণ থেকে। তাঁদের কাছে শিল্পকে পৌঁছে দেওয়াও তো তবে শিল্পীদেরই কাজ। এমন একটা চিন্তাভাবনা থেকেই ফুটপাথে খোলা আকাশের নিচে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে ‘ছবিওয়ালা’। 

নন্দনের ঠিক উল্টোদিকেই মোহরকুঞ্জে আজ থেকেই শুরু হয়েছে এই প্রদর্শনী। চলবে কাল পর্যন্ত। চলতি বছরে তৃতীয় বর্ষে পা দিল কলকাতার এই স্ট্রিট আর্ট এগজিবিশন। ২০১৯ সালে ক্রিসমাসের প্রাক্বালে প্রথমবারের জন্য পথ-প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল ‘ছবিওয়ালা’। সেবারেও মোহরকুঞ্জেই বসেছিল প্রদর্শনীর আসর। ২০২০ সালে ছক ভেঙে বীরভূমের সিউড়িতেও এই ধরনের প্রদর্শনী হয়েছিল তরুণ শিল্পীদের তত্ত্বাবধানে। মহামারীকালীন সময়ে দেশ-বিদেশের বাঙালি শিল্পীদের ছবি নিয়ে আয়োজিত হয়েছিল অনলাইন প্রদর্শনীও। 

আরও পড়ুন
হুগলি নদী ও পৃথিবীর ‘বন্ধুত্বের’ প্রদর্শনী

তবে প্রথা ভাঙার এই অভ্যাস জন্মলগ্ন থেকেই জড়িয়ে রয়েছে ‘ছবিওয়ালা’-র সঙ্গে। বছর চারেক আগের কথা। বাংলারই একদল তরুণ শিল্পীর হাত ধরে শুরু হয়েছিল ‘ছবিওয়ালা’-র পথচলা। না, তাঁদের কোনো শংসাপত্র নেই, নেই আর্ট কলেজের সার্টিফিকেটও। কেবলমাত্র ভালোবেসেই আঁকড়ে থাকা শিল্পকে। সৌরভ মিত্রের কথায়, ‘স্বশিক্ষিত ও অশিক্ষিতের দল’-ই গড়ে তুলেছিল ‘ছবিওয়ালা’-কে। বলতে গেলে প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধেই এ যেন সম্মুখ সমর ছিল তরুণ-তুর্কি শিল্পীদের কাছে। 

আরও পড়ুন
শিল্পীদের তুলিতে পরিবেশ ও জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রদর্শনী মার্কিন রেস্তোরাঁয়

আরও পড়ুন
শিল্পী হরেন দাসের আঁকা ছবির প্রদর্শনী দক্ষিণ কলকাতায়

‘ছবিওয়ালার’-র আরেক কর্ণধার বিপ্লব ধর জানালেন, “প্রথাগত কলকাতার আর্ট গ্যালারি ধারণা ভাঙতেই যেহেতু আমাদের এই উদ্যোগ। তাই প্রদর্শনীর জায়গা হিসাবে আমরা বেছে নিয়েছিলাম মোহরকুঞ্জকে।” অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের ঠিক বিপরীতেই শিল্পের মুক্তাঙ্গন তৈরি করতে চেয়েছিলেন তরুণ শিল্পীরা। মানুষকে গ্যালারি নয়, বরং এ যেন গ্যালারিকেই মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা।

তবে এখানেই থেমে থাকা নয়। সৌরভ মিত্র জানালেন, “আগামীদিনে শুধু কলকাতা নয়, বাংলার বিভিন্ন গ্রাম ও মফস্বলেও পথ-প্রদর্শনীর আয়োজন করার চিন্তাভাবনা রয়েছে আমাদের”। প্রান্তিক মানুষদের কাছে শিল্পকে পৌঁছে দেওয়াও যে অন্যতম কর্তব্য শিল্পীর। আর সেই লক্ষ্যেই ক্রমশ গুটি সাজাচ্ছে ‘ছবিওয়ালা’। এই লড়াইকে বাংলার ‘শিল্পবিপ্লব’ বললেও ভুল হয় না এতটুকু…

Powered by Froala Editor