শিল্পী হরেন দাসের আঁকা ছবির প্রদর্শনী দক্ষিণ কলকাতায়

‘আজ থেকে বছর বারো আগেও হরেনবাবুর ছবির তেমন দর ছিল না…’

কথা হচ্ছিল ‘দেবভাষার কর্ণধার সৌরভ দে-র সঙ্গে। ২৯ অক্টোবর থেকে গোলপার্ক ‘দেবভাষা (Debovasha) গ্যালারিতে শিল্পী হরেন্দ্র নারায়ণ দাস ওরফে হরেন দাসের (Haren Das) ছবি প্রদর্শনী চলছে। উপলক্ষ— শিল্পীর শতবর্ষ। উদ্বোধন করে গিয়েছেন গণেশ হালুই এবং যোগেন চৌধুরী। উডকাট-লিনোকাট-এচিং মিলিয়ে প্রায় শখানেক ছবি। গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের ব্রিটিশ ঘরানার ছাপ স্পষ্ট। এর আগেও অবশ্য হরেনবাবুর কাজ চর্মচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। কিন্তু দেখেছি, খুবই কম। স্পেস, পারস্পেক্টিভ, এবং খুঁতহীনতায় হরেনবাবু অনন্য। যেমন টেম্পল গেট বা মন্দির-দ্বার নামক ছবিটিকেই ধরুন। বলা ভালো উড-এনগ্রেভিং। সে ছবিতে সাদা স্পেসে মন্দিরের সিঁড়ি ভাঙা ভক্ত সমাগম। আবার ঠিক তার পাশেই অন্ধকার ফুঁড়ে আলোকিত হয়ে উঠছে জগন্নাথদেবের অবয়ব। প্রত্যেকটা রেখা নিপুণ। প্রত্যেকটা আঁচড় নিটোল। সাদা-কালোর এমন খেলা বাংলার প্রিন্টমেকিং-এর ইতিহাসে খুব কম শিল্পীই দেখিয়েছেন। হরেনবাবুর সব ছবিতেই এমন শৈলী দেখা যায়…

সামার বাথ। এচিং। ৯.৭ X ১৩.৩ ইঞ্চি। ১৯৭৬।

 

আনওয়েলকাম ভিসিটারস। লিনো। এডিসন ২৩ আউট অফ ২৫। ১১.৩X ৭.৫ ইঞ্চি। ১৯৫২।

 

আরও পড়ুন
৩০ বছর ধরে আঁকা ছবি, অবশেষে প্রকাশ্যে শিল্পীর সৃষ্টি

টেম্পল গেট। উডকাট। ১৩.৬ X ৯.৬ ইঞ্চি। ১৯৯১।

 

আরও পড়ুন
একটিও ছবি বিক্রি না করেই ১০০ মিলিয়ন ডলারের মালিক এই শিল্পী!

দিনাজপুরের এক গণ্ডগ্রাম থেকে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে পড়তে আসা। সেখানেই সর্বজনবিদিত শিল্পী রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর নজরে পড়েন হরেন। রমেন্দ্রনাথের কাছেই প্রিন্টমেকিং-এ নাড়া বাঁধলেন তিনি। রমেনবাবু জাপানি ‘উকিও-এ' ঘরানার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ফলে জাপানী প্রিন্টের সূক্ষ্মতা সঞ্চারিত হল হরেনের ছবিতেও। বলা বাহুল্য, এর সঙ্গে মিশল পাশ্চাত্য শৈলী। 

আরও পড়ুন
শিল্পের খিদে মেটাতে ভিন্নপথে আত্মানুসন্ধান কে-পপ গায়কদের

পিসফুল কো-এগজিস্টেন্স। কালার এচিং। ৭.৭ X ৯.৬ ইঞ্চি। ১৯৫৯।

 

হার পেট। উডকাট। ৫.৪X ৩.৩ ইঞ্চি। ১৯৪৮।

 

কেদারনাথ। কালার এচিং। এডিসন ১০ আউট অফ ১৫। ১২.৬ X ১৫.৫ ইঞ্চি। ১৯৮৪।

 

‘শুনেছি, হরেনবাবু বলতেন, আমি অতশত বুঝি না। যা দেখি, তাই আঁকি। এবার একে কি শিল্পীর ছদ্মবিনয় বলবেন?’ বলছিলেন সৌরভ। ২০ নভেম্বর অবধি চলবে প্রদর্শনী। তারপর হরেনের ছবিগুলিকে নিয়ে দেবভাষা থেকে একটি ক্যাটালগ বা বই প্রকাশ হতে চলেছে আগামী ২৫ ডিসেম্বর। 

স্ট্রিট শো। ড্রাই পয়েন্ট। ৪.৭X ৬ ইঞ্চি। ১৯৪৮।

 

মুশকিল আসান। উডকাট। ১৪X ১০.২ ইঞ্চি। ১৯৬৩।

 

শিল্পীপুত্র চন্দন দাসের সৌজন্যে ছবিগুলি এসেছে দেবভাষায়। এর আগেও নাকি চন্দন দু'বার এক্সিবিশন করেছেন অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে। সবে সেগুলি নেহাত পারিবারিক উদ্যোগ। তবে শিল্পীর মৃত্যুর পরে এই প্রথম কোনো সংস্থা বা আর্ট গ্যালারি এগিয়ে এসে হরেন দাসের ছবিগুলি নিয়ে এত বড় মাপের প্রদর্শনী করল। এর মধ্যেই বিক্রি হয়ে গিয়েছে মোট ৭১টি ছবি। করোনাবিধি মেনেও দর্শকের আনাগোনা বাড়ছে। জীবদ্দশায় প্রচুর খ্যাতি কুড়োলেও বাংলার শিল্পীমহলে হরেন খানিক ব্রাত্য। কারণটা অনুমান করা বেশ সহজ।  তিনি চিত্তপ্রসাদ, সোমনাথ হোড়, বা জয়নাল আবেদিনের মতো ছক-ভাঙা শিল্পী নন। তাঁর উডকাট বা এচিং-এ মন্বন্তর ধরা পড়ে না। রাজনৈতিক টালমাটাল, লড়াই-আন্দোলনের আগুন সেখানে নেই। বরং তাঁর সাবজেক্ট নম্র, স্নিগ্ধ, গতানুগতিক। উল্টোদিকে শান্তিকেতনী চিত্রশৈলীর কমনীয়তাও হরেনের রেখায় পাওয়া যাবে না। তিনি সেখানে বলিষ্ঠ, দৃঢ়। হয়তো এই ‘না ঘর-কা/ না ঘাট-কা’ হওয়ার সুবাদেই হরেন এতদিন খানিক উপেক্ষিতই ছিলেন। তবে দক্ষিণ কলকাতার একপ্রান্তে ‘ছোট্ট' গ্যালারির হাত ধরেই হয়তো তাঁর জয়যাত্রা শুরু হল।


Powered by Froala Editor