বাস কন্ডাক্টর থেকে পুরস্কারজয়ী পরিচালক, মণিপুরের বিচিত্র জীবনের সাক্ষী অমর

সীমান্ত বললেই যদি চোখের সামনে ভেসে ওঠে সামরিক পোশাক পরা সেনানীদের, তাহলে একটু ভুল হবে। সীমান্ত অঞ্চলের জীবনের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছেন যেসব সাধারণ মানুষ, তাঁরাও একেকজন সৈনিক। অমরজিৎ মাইবামের তথ্যচিত্র তুলে ধরে সেইসব সাধারণ মানুষের জীবন। ঠিক সেভাবেই শুরু হয়েছে 'হাইওয়েজ অফ লাইফ' সিনেমাটিও। ইম্ফল শহর থেকে মায়ানমার সীমান্ত ছুঁয়ে মোরে গ্রাম পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তা জুড়ে রেখেছে ২ নম্বর এবং ৩৭ নম্বর হাইওয়ে। আর তার মধ্যেই দিন কাটে অসংখ্য ট্রাক ড্রাইভারের। কোথাও পাহাড়ি রাস্তায় ধস নামলে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে যায় সমস্ত ট্রাক। কখনো তার নিচেই চলে রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়া।

অবশ্য এখানেই শেষ নয়। সীমান্ত অঞ্চলের এই মানুষদের জীবন কাঁটাতারের দুই পারে বাঁধা। কখনও এদিক থেকে ওপারে চলে যায় ব্যবসার সামগ্রী, কখনো ওপার থেকে আসে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। আর এই আদানপ্রদানের মধ্যে আছে সীমান্ত রক্ষা বাহিনী এবং পুলিশের ধরপাকড়। আর এই সব দৃশ্যই ক্যামেরাবন্দি করেছেন ট্রাক ড্রাইভারদের অতি পরিচিত অমর।

হ্যাঁ, কর্মসূত্রে তার দীর্ঘদিনের আসা যাওয়া এই রাস্তায়। পারিবারিক অর্থনীতি যখন একেবারে ভেঙে পড়েছিল, তখন সদ্য ম্যাট্রিকুলেশন দেওয়া অমর পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন বাসের কন্ডাক্টরের কাজ। আর সেই বাস চলত এই রাস্তাতেই। সেটা ১৯৯৫ সালের কথা। বাসের কন্ডাক্টরের কাজ করতে করতেই পড়াশুনো চালিয়ে গিয়েছেন অমর। খানিকটা আর্থিক স্বচ্ছলতার মুখও দেখেছেন। ২০০০ সালে নিজেই কিনে ফেলেছেন ২টি বাস। কিন্তু বাবার কাছ থেকে যে শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন, তা সঙ্গে থেকেছে সারাজীবন।

এক সময়ের এফটিআইআইয়ের ছাত্র এম এ সিং ফিল্ম এডিটিং এবং চলচ্চিত্র পরিচালনার সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িত থাকার পরে আর্থিক কারণেই সেসব ছেড়ে দিয়েছিলেন। মণিপুরের স্থানীয় ভাষায় একাধিক পূর্ণ দৈর্ঘ্যের সিনেমা বানিয়ে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলেন, কিন্তু টাকা পাননি। তবে সেই ভালোবাসাটুকুই উজাড় করে দিয়েছিলেন ছেলের মধ্যে। তাই শেষ পর্যন্ত অমর নিজেও ফিরে এলেন বাবার পা রাখা পথেই। কলকাতায় এসে সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট থেকে পড়াশুনোও করেছেন তিনি। আর তারপর মণিপুরে ফিরে গিয়ে বানাতে শুরু করলেন একের পর এক সিনেমা।

আরও পড়ুন
বাঁশের তৈরি টিফিনকৌটো, প্লাস্টিক রুখতে অভিনব উদ্যোগ মণিপুরে

'সিটি অফ ভিকটিম' এবং 'মাই জেনারাস ভিলেজ' নামের দুটি তথ্যচিত্রতেও মণিপুরের সাধারণ মানুষের জীবন, তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রামের কথাই তুলে ধরেছেন অমর। সেইসঙ্গে পরিচালনা করেছেন দূরদর্শন থেকে সম্প্রচারিত একটি ১০ এপিসোডের টেলি-প্লে। তবে এই তালিকায় অবশ্যই একটা মাইলস্টোন হতে চলেছে 'হাইওয়েজ অফ লাইফ'। ২০১৪ সাল থেকে শুরু হয়েছে এই সিনেমা তৈরির কাজ। আর প্রায় ৫ বছরের চেষ্টা বিফলে যায়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশের লিবারেশন-ডকফেস্ট থেকে সেরা সিনেমা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে এই তথ্যচিত্র। এছাড়াও মণিপুর রাজ্য চলচ্চিত্র উৎসবে পেয়েছে আরও ৪টি পুরস্কার। এই স্বীকৃতিটুকুই তো চেয়েছিলেন অমর। তাঁকে আর বাসের কন্ডাক্টর হিসাবে হয়তো দেখা যাবে না কোনোদিন। কিন্তু জীবনের রেখাপথে ২ নম্বর আর ৩৭ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে যাবে চিরকাল।

আরও পড়ুন
মণিপুর থেকে উদ্ধার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ২৭টি বোমা, রয়েছে সক্রিয় অবস্থাতেই

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
পরপর দুটি ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল উত্তর-পূর্ব ভারতের পাঁচ রাজ্য, কেন্দ্র মণিপুর