ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে কলকাতার কিছু বিশেষ অঞ্চলে, সিলোয়েট জুড়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত বিশেষ কিছু গির্জার চূড়ো। তবে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিজস্ব কলোনি বা সাহেবপাড়ায় নির্মিত চার্চে ইউরোপীয়দের আসা-যাওয়াই ছিল বেশি। সেখানে ‘নেটিভ খ্রিশ্চান’ বা বাঙালি খ্রিস্ট-ধর্মাবলম্বীদের সমাগম খুব একটা হত না। পোর্তুগিজ, আর্মেনিয়, গ্রিক - এদের নিজস্ব গির্জা থাকলেও ‘নেটিভ খ্রিশ্চান’দের কোনো নিজস্ব গির্জা নির্মাণ হতে বেশ খানিকটা সময় লাগে। তার কারণ বোধহয় তাঁদের ওই ‘নেটিভ’ পরিচয়টিই।
নানারকম প্রতিকূলতার মুখে বাধ্য হয়ে অবশেষে নেটিভ কনভার্ট (ধর্মান্তরিত স্থানীয়রা) এবং নেটিভ পাদ্রিদের জন্য নেটিভ চার্চ নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মানে, এই প্রথম আর্মেনিয় বা পোর্তুগিজ গির্জার মতো বাঙালিরাও পাবে নিজেদের গির্জা। উত্তর কলকাতা বেশি জনবহুল হওয়ায়, সেখানেই নেটিভ খ্রিস্টধর্মীদের সংখ্যা বেশি, স্বাভাবিক ভাবে সেখানেই নেটিভ গির্জা নির্মাণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। একমাত্র ব্যতিক্রম দক্ষিণের ভবানীপুর অঞ্চল, সেখানকার নেটিভদের জন্য ভবানীপুর চার্চ নির্মাণ করা হয় ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে। একেবারে শুরুতেই না হলেও, ক্রমে বিদেশি পাদ্রিদের জায়গা পুরোপুরি ভাবে নিতে সক্ষম হন ভারতীয় তথা বাঙালি পাদ্রিরা (খ্রাইস্ট চার্চের মত কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে)।
কলকাতার গির্জার বিষয় আলোচনা বিনোদ ঘোষের মন্তব্য এইরূপ –
“গির্জার আঞ্চলিক অবস্থান সম্বন্ধে একথা বললেও ভুল হয় না যে উত্তরে বৌবাজার এবং পুবে ও দক্ষিণে সার্কুলার রোড, এই সীমানার মধ্যেই কলকাতার শতকরা ৯৫টি গির্জা প্রতিষ্ঠিত। তার কারণ এই সীমানার মধ্যেই ইংরেজ ও অন্যান্য খ্রীষ্ঠানদের বসবাস, কাজকর্ম ইত্যাধি প্রধানত আবদ্ধ ছিল।”
এই ৯৫ শতাংশ গির্জা এবং এই বিশেষ অঞ্চলের বাইরে যে কলকাতা শহরে খ্রিস্টধর্মের প্রচার এবং বিস্তার, তার প্রধান কাণ্ডারি তিনটি নেটিভ চার্চ। এবং এই তিনটি চার্চের উৎকর্ষের পেছনেও তিনজন কলকাতাবাসীর গৌরবময় প্রচেষ্টা জড়িয়ে আছে। গির্জাগুলি যথাক্রমে –
• অ্যামহার্স্ট স্ট্রিটে লং সাহেবের গির্জা – বিশিষ্ট ভারতবন্ধু বিদেশি জেমস লং-এর কর্মস্থল।
• হেদুয়ার পশ্চিমে, বেথুন কলেজের ডানদিকে অবস্থিত খ্রাইস্ট চার্চ গির্জা (কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গির্জা নামে পরিচিত) – কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুদক্ষ পরিচালনায় চালিত।
• হেদুয়ার পূর্ব দিকে আলেকজান্ডার ডাফের স্মৃতিতে ডাফ চার্চ - রেভারেন্ড লালবিহারী দে’র কর্মস্থল।
এই তিন নেটিভ গির্জা, তাদের নির্মাণের ইতিহাস এবং বঙ্গীয় সমাজের বিবর্তনে এদের অবদান… এই অধ্যায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং চিত্তাকর্ষক। কিন্তু এছাড়াও এমন অনেক গির্জার কথা একে একে উঠে আসে, যাদের উপস্থিতি কলকাতার প্রাচীন ইতিহাসকে আরও বর্ণময় করে তুলেছে। তারই একটি হ'ল এলগিন রোডে অবস্থিত সেন্ট মেরিজ গির্জা; যাকে বলা হত বাংলা ক্যাথিড্রাল… বা, হয়তো বলা ভালো বাঙালিদের ক্যাথিড্রাল।
এলগিন রোড (লালা লাজপত রাই সরণী)-এ ভবানীপুর এডুকেশন সোসাইটি কলেজের বিপরীত দিকে তাকালেই দেখা যাবে বাঙালি প্রোটেস্টান্টদের বাংলা ক্যাথিড্রাল - সেন্ট মেরিজ চার্চ। নাম কেন বাংলা ক্যাথিড্রাল, সেটা ভেতরে প্রবেশ করে ফলকগুলোকে দেখলেই বোঝা যাবে, প্রায় সব ফলকই ঝরঝরে বাংলায় লিপিবদ্ধ, তা সে যতই পুরনো হোক।
১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত সেন্ট মেরিজ চার্চ 'বাংলা ক্যাথিড্রাল' নামে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, কারণ এই গির্জার বেশির ভাগ সদস্যই ছিলেন বাঙালি প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টান। এই বাংলা ক্যাথিড্রালের উদ্ভাবক রেভারেন্ড হরিহর সান্ডেল (সান্যাল) একজন সম্মানিত মিশনারি ছিলেন। এই অগ্রদূত প্রোটেস্টান্ট মিশনারি প্রথম কিছু খ্রিস্টান সহকর্মীদের নিয়ে ক্যাথিড্রালের সূচনা করেন, এবং পরিকল্পনা করেন একটি বড়ো গির্জা নির্মাণের। বাঙালি প্রোটেস্টান্টদের গির্জা নির্মাণের জন্য তিনিই উদ্যোগ নিয়ে জমির ব্যবস্থা এবং অর্থসংগ্রহের ব্যবস্থা করেন। তবে দুঃখের বিষয়, বাংলা ক্যাথিড্রালের এই গির্জা জনসাধারণের জন্য খোলার আগেই হরিহর সান্ডেলের জীবনাবসান হয় (৪ঠা সেপ্টেম্বার, ১৮৮৭)। ১৬ই ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৯ সেন্ট মেরিজ চার্চ বা বাংলা ক্যাথিড্রালের দ্বারোদ্ঘাটন হয় রেভারেণ্ড অঘোর নাথ ব্যানার্জীর নেতৃত্বে। পরবর্তীকালে রেভারেণ্ড ব্যানার্জী সেন্ট পল'স ক্যাথিড্রালের ক্যানন নিযুক্ত হন। সেন্ট পল'স ক্যাথিড্রালের উনিই প্রথম ভারতীয় ক্যানন হয়েছিলেন।
ঔপনিবেশিক কলকাতা, এবং বাঙালি নবজাগারণের ইতিহাসের একটা উজ্জ্বল টুকরো এই সেন্ট মেরিজ গির্জা, একবার গিয়ে দেখে আসুন… অনুভব করতে পারবেন, এই গির্জা কীভাবে একসময় বাঙালির আত্মসম্মানরক্ষার প্রতিভূ হয়ে উঠেছিল। যে খ্রিস্টান সমাজে বাঙালি (যাদের নেটিভ বলা হত) জাতির গুরুত্ব এবং অধিকারের জন্য যে লড়াইটা রেভারেণ্ড লালবিহারী দে-রা শুরু করেছিলেন, তারই আর এক মাইল-ফলক ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে নির্মিত এই গির্জা। হয়তো, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ গুরুত্বপূর্ণ বাঙালিদের গির্জা নির্মাণের প্রচেষ্টার সাক্ষী - সেন্ট মেরিজ চার্চ।
শুধু ধর্মীয় স্থান, বা ধর্মপ্রচারের মাধ্যম ভেবে নিলে, হয়তো বাঙালির আত্মসম্মানের লড়াইয়ের একটা অধ্যায়কেই খর্ব করে দেওয়া হবে।
Powered by Froala Editor