স্পাইডারম্যান হোক বা হাল্ক – শৈশবের ‘সুপারহিরো’দের জন্ম দিয়েছিলেন যিনি

হাইস্কুলের ছাত্র পিটার পার্কার। রোগাপটকা। জ্বরজারিতে রুগ্ন। তাছাড়া সংসারে অনটনের শেষ নেই। পাশের বাড়ির মেয়েটিকে মনে মনে ভালোবাসলেও, সে দেখেও দেখে না। কিন্তু পিটার ছাত্র ভালোই। অঙ্ক আর বিজ্ঞানে অদ্ভুত মাথা খোলে তার। জলপানির জোরে পার হয়ে যায় ইস্কুল কলেজ। পার্ট টাইম রোজগারে মেটায় নিজের খরচ। ইচ্ছা, বিজ্ঞানী হওয়ার। আর, নেশা বলতে ছবি তোলা।

বাস্তবের সঙ্গে কী অদ্ভুত মিল, তাই না! চারপাশে তো এমন হাজার হাজার পিটারকেই ঘুরে বেড়াতে দেখি… এমন একটি ছেলেকেই একদিন কামড়ে দিল 'তেজস্ক্রিয়' মাকড়সা, তারপর সে রাতারাতি হয়ে গেল সুপারহিরো… স্পাইডারম্যান। আকাশকুসুম কল্পনা যদি বাস্তবের আকাঙ্খাগুলো পুরণ করে দিতে পারত, তাহলে তো গল্পটা শেষ হয়ে যেত এখানেই। কিন্ত ভিলেনদের পিটিয়ে পাট-পাট করা পিটার, এখনও ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স দেখে হোঁচট খায়। চাকরির সমস্যা, ভাঙা প্রেম, কাকিমার অসুখ… জীবনে সমস্যা তো আর শেষ হয় না!

মুখোশ পরলেই সে সুপারহিরো, মুখোশ খুললেই হেরে যাওয়া একটা ছেলে। তা সত্ত্বেও হাল ছাড়ে না পিটার। হাল ছাড়তে জানে না সে। পিটারের গল্প পড়তে পড়তে আমরা কখনো হাসতে হাসতে ফেটে পড়ি, কখনো বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে কান্না। 'অতিমানব' শব্দটির শেষেও যে আসলে 'মানব' থাকে।

এমন চরিত্রেরই স্রষ্টা স্ট্যান লি। আজ তাঁর জন্মদিন।

১৯৩৮-১৯৩৯ সালে আত্মপ্রকাশ করে ব্যাটম্যান। সৌজন্যে 'ডিটেকটিভ কমিকস' অথবা ডিসি। আর চল্লিশের দশকে পাতাজুড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে সুপারম্যান। বিশ্বযুদ্ধের বাজারে এরাই কমিকস দুনিয়া কাঁপাত। কিন্ত যুদ্ধের পরেই খানিক মন্দা এল বাজারে। বিক্রি হতে চায় না কপি। তাছাড়া, কমিকস ততদিনে শুধু আর শিশুপাঠ্য নেই, বড়দেরও হাতে হাতে ফিরছে। শুধু গাঁজাখুরি, সরস গপ্প বলে আর লাভ নেই, চাই বাস্তবের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ…

সেই উপাদান যোগাতেই হয়তো কলম ধরছেন স্ট্যান। মূল নাম স্ট্যানলি মার্টিন লিবার। সেই ১৯২২ সালে তিনি জন্মেছেন ম্যানহাটানের নিম্নবিত্ত ইহুদি পরিবারে। ছোট্টবেলা থেকেই লেখার শখ। চেয়েছিলেন, জে স্কট ফিটজেরাল্ডের মত ঔপন্যাসিক হতে। কিন্ত বাদ সাধল অভাব। স্ট্যান যোগ দিচ্ছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। বেতারবিভাগে মেকানিক হিসেবে। সেনাবাহিনীর প্রচারের জন্য কার্টুন, কমিকস, বিজ্ঞাপনও লিখেছেন তখন। তাঁর উদ্ভট কল্পনাশক্তির কথা ছড়িয়ে পড়েছে সেনাছাউনির অন্দরে।

যুদ্ধ শেষ। ফিরে এসে স্ট্যান যোগ দিলেন 'এটলাস' কমিকসের অফিসে। লেখক হিসেবেই। 'এটলাস' পরে নাম পাল্টে 'মার্ভেল' হবে। প্রথমে স্টিভ ডিটকো, তারপর জ্যাক কীর্বির সঙ্গে জুটি বেঁধেই সৃষ্টি হল ফ্যান্টাস্টিক ফোর, হাল্ক, থর, ব্ল্যাক প্যান্থার, ডেয়ারডেভিলদের মত সুপারহিরোদের। কীর্বির আঁকা, আর স্ট্যানের অনবদ্য সংলাপে মেতে ওঠে আবালবৃদ্ধবনিতা। স্ট্যানের লেখায়, সুপারহিরোরা রক্তমাংসের মানুষ। যেমন ডেয়ারডেভিল আসলে দৃষ্টিহীন। কিংবা 'হাল্ক' নিজের শক্তিকে ঠিক বশে আনতে পারে না। প্রত্যেকের জীবনে বাসা বেঁধেছে যন্ত্রণা। অবসাদ। নিজেরা নিজেদের মত করেই লড়াই চালায় সমাজের সঙ্গে। বারংবার ধাক্কা খেতে খেতে তারা শেখে। একেকটি ভুলের মাশুল গুনতে হয় বহুগুণ…

ডিসি কমিকসের বাজার ধরে ফেলেছিল মার্ভেল। এর কারণ অবশ্যই 'মার্ভেল বুলপেন বুলেটিনস'। প্রত্যেকটি কমিকসের পেছনে বাস্তব-কল্পনার মিশেলে দৈনন্দিন ঘটনার বিবরণ থাকত সুপারহিরোদের মুখে। পাঠকদের উদ্দেশ্যেও ছিল প্রশ্ন। সেইসব সংলাপও লিখতেন স্ট্যান। মাঝে মাঝে তাঁকে দেখা যেত উৎসুক তরুণ-তরুণীদের তারিণীখুড়ো রূপে। অটোগ্রাফের খাতা ফেরাতেন না তিনি।

২০১৮ সালের পর থেকে কেবল দু'মলাটের মাঝেই রয়ে গিয়েছেন স্ট্যান লি…