ভারত কিংবা পাকিস্তান নয়, ‘স্বাধীন’ থাকতে চেয়েছিল ভারতের এই রাজ্যগুলি

ব্রিটিশ ভারতবর্ষের মধ্যেও দক্ষিণ ভারতে প্রিন্সলি রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ত্রিবাঙ্কুর। ১৭৯৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল ত্রিবাঙ্কুর। তাই রাজত্ব থাকলেও স্বায়ত্ব শাসনের অধিকার খর্ব করেছিল ইংরেজ সরকার। ১৯৪৭ সালে যখন দেশভাগের প্রসঙ্গ উঠল, তখন ত্রিবাঙ্কুরের তৎকালীন রাজা স্যর সিপি রামাস্বামী আইয়ার। তিনি স্পষ্টতই জানিয়ে দিলেন, ভারত কিংবা পাকিস্তান কোনো দেশেই অন্তর্ভুক্ত হবে না কেরলের ত্রিবাঙ্কুর। বরং ১৭৯৫-এর আগে যেমন স্বাধীন ছিল ত্রিবাঙ্কুর, তেমনই একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে সেটি। মহম্মদ আলি জিন্না রামাস্বামীর এই সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও, সংযুক্তিকরণের চেষ্টা চালিয়ে যায় ভারতীয় কংগ্রেস। তবে সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন ত্রিবাঙ্কুর-রাজ।

এরই মধ্যে ঘটে যায় একটি দুর্ঘটনা। রামাস্বামী আইয়ারকে হত্যার চেষ্টা করেন কেরলেরই এক সমাজকর্মী। গুরুতর আহত হয়েই হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। ১৯৪৭ এর জুলাই অবধিও তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেও, এই ঘটনার পরেই সিদ্ধান্তবদল করেন আইয়ার। ৩০ জুলাই ঘোষণা করেন, ত্রিবাঙ্কুরও অখণ্ড ভারতের অংশ হতে চলেছে।

এই ঘটনার বছর খানেক সময় পিছিয়ে যাওয়া যাক। স্বাধীনতার প্রাক্কালে দেশের অবস্থা তখন অগ্নিগর্ভ। দেশভাগ নিয়ে দুই শীর্ষস্থানীয় দলীয় নেতা নেহেরু এবং জিন্নার মতানৈক্যে আগুন জ্বলে উঠল সাম্প্রতিক দাঙ্গার। এই পরিস্থিতিতে যত দ্রুত সম্ভব ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য মুখিয়ে ছিল ব্রিটিশরাজ। তবে দেশভাগের ক্ষেত্রে আরও একটি বড় সমস্যা দেখা দিল। ভারতে তখন সব মিলিয়ে বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে ৫৬৫টি প্রিন্সলি স্টেট। সবমিলিয়ে অবিভক্ত ভারতবর্ষের ৪৮ শতাংশ আয়তন এই স্টেটগুলির। তৎকালীন ভারতীয় জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ মানুষে বসবাস এই অঞ্চলে। দেশভাগের প্রাক্কালে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে এই রাজ্যগুলিরই রাজনৈতিক অবস্থান।

ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা পাকাপাকি হল ১৯৪৭ এর ১৫ অগস্ট। কিন্তু ঝুলে থাকল এই প্রিন্সলি স্টেটগুলির ভাগ্য। অনেকটা দায়-সারা ভাবেই মাউন্টব্যাটেন এই রাজ্যগুলির দায়ভার চাপিয়ে দিলেন পরবর্তী রাষ্ট্রনেতাদের ওপর। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং ভিপি মেননের দায়িত্ব নিলেন সংযুক্তিকরণের। সাড়ে পাঁচ শো’র বেশি রাজ্য হয় ভারত নয়, পাকিস্তানকে বেছে নিল স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের জন্য। তবে পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কয়েকটি রাজ্য। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ত্রিবাঙ্কুর, ভোপাল, যোধপুর, হায়দ্রাবাদ এবং জুনাগড়। ভারত কিংবা পাকিস্তান কোনো দেশেরই অন্তর্ভুক্ত হতে চাইল না রাজ্যগুলো। বা চাইলেও দেখা দিল অন্য সমস্যা। সেইসঙ্গেই উঠে এল স্বাধীন পৃথক রাষ্ট্রগঠনের প্রস্তাব।

আরও পড়ুন
জনসংখ্যা মাত্র ৩০০, স্বাধীনতার দাবিতে লড়ছে ইতালির ছোট্ট গ্রাম

ত্রিবাঙ্কুরের মতই সমস্যা দেখা দিয়েছিল হায়দ্রাবাদেও। ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের মধ্যেই সংযুক্তিকরণের রাস্তা খোলা থাকলেও, সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভৌগলিক অবস্থান। একদিকে যেমন ভারতীয় ভূখণ্ডের মাঝে অবস্থান করায় বন্ধ হয়েছিল পাকিস্তানের অন্তর্ভুকির পথ। তেমনই রাজ্যের বেশিরভাগ প্রজাই হিন্দু হওয়ায় বাড়তি সমস্যা দেখা দিয়েছিল পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তিকরণে। তাই দুই দেশের বদলে তৎকালীন হায়দ্রাবাদের শাসক নিজাম মির উসমান আলি চেয়েছিলেন ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অর্ন্তগত হতে। তবে মাউন্টব্যাটেন সেই প্রস্তাব খারিজ করে দেন।

আরও পড়ুন
বিশ্বজুড়ে স্বাধীনতা হারাচ্ছেন সাংবাদিকেরা, পিছিয়ে নেই ভারতও

তবে হায়দ্রাবাদের পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়ানক হয়ে উঠছিল। সাম্প্রতিক দাঙ্গা এবং হিংসা দৈনন্দিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছিল হায়দ্রাবাদে। ভারতীয় ভূভাগের মধ্যেই সেই সংঘর্ষ অনেকটা ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়ছিল পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেও। মাউন্টব্যাটেনের পদত্যাগের পরই ১৯৪৮ সালে জুন মাসে বল্লভভাই প্যাটেল ভারতীয় সেনা পাঠান ওই অঞ্চলে। চারদিনের সশস্ত্র লড়াইয়ের পর হায়দ্রাবাদের নিয়ন্ত্রণ আয়ত্ত করে ভারতীয় সেনা। নিজাম মতামত পাল্টে যোগ দিয়েছিলেন ভারত সরকারের পক্ষে। তাঁর এই সিদ্ধান্তবদলের জন্য হায়দ্রাবাদের প্রথম রাজ্যপালের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।

আরও পড়ুন
স্বাধীনতার ৭৫ বছরে বিশেষ পডকাস্ট সিরিজ, আইএনএ-র কাহিনি দিয়ে যাত্রা শুরু

হায়দ্রাবাদের মতই হিংসা ছড়িয়েছিল গুজরাটের আরেক প্রিন্সলি স্টেট জুনাগড়ে। স্বাধীনতার সময় ১৯৪৭ সালে জুনাগড় স্বাধীন রাজ্য হিসাবেই প্রতিষ্ঠিত করেছিল নিজেকে। পরবর্তীতে নবাব মুহম্মদ মহাবত খান চেয়েছিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত হতে। তবে ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম হিন্দু জনগোষ্ঠীর রাজ্য হওয়ায় সমস্যা দেখা দিয়েছিল সেই সিদ্ধান্তে। বোম্বেতে জুনাগড়ের একটি অস্থায়ী সরকারও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে উঠেছিল যে বাধ্য হয়েই পাকিস্তানের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন নবাব। এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। কিন্তু পাকিস্তানের থেকে কোনো প্রত্যুত্তরই পাননি তিনি। ১৯৪৮ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে রাজ্যে মতামতের সিদ্ধান্তগ্রহণের জন্য একটি নির্বাচন করা হয়। সেখানে ৯১ শতাংশ ভোটার নিশ্চিত করেন ভারতের সঙ্গে জুনাগড়ের সংযুক্তি। ১৯৬০ সাল অবধিই বোম্বে প্রোভিন্সের অন্তর্গত ছিল জুনাগড়। ১৯৬০ সালের ১ মে মহারাষ্ট্র এবং গুজরাটকে দুটি পৃথক রাজ্যে ভাগ করে দেয় ভারত সরকার।

পশ্চিম ভারতের আরও একটি প্রভাবশালী স্বাধীন রাজ্য ছিল যোধপুর। রাজস্থানের রাজপুত রাজ্য। অধিকাংশ প্রজা এবং রাজা হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও মহারাজা হনভন্ত সিং প্রাথমিকভাবে চেয়েছিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত হতে। তার কারণ যদিও অস্পষ্ট। তাও প্রচলিত আছে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দেওয়া খানিক লাভবান ছিল বলেই মনে করেছিলেন হনভন্ত সিং। মহম্মদ আলি জিন্নার সঙ্গে বেশ কয়েকটি বৈঠকও হয়। জিন্না একটি সাদা কাগজ এগিয়ে দিয়েছিলেন মহারাজার দিকে। লিখে দিতে বলেছিলেন তাঁর শর্তগুলি। তবে শেষ মুহূর্তে যোধপুরের পাকিস্তান-সংযুক্তির পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ান বল্লভভাই প্যাটেল। মহারাজার সঙ্গে কথা বলেই পর্যাপ্ত সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। তাতে যোগদানে সম্মতও হয়েছিলেন মহারাজ। ১৯৪৮ সালের শুরুতেই ভারতের অংশ হয়ে ওঠে যোধপুর।

এবার মধ্য ভারতের কথা আসা যাক। প্রিন্সলি স্টেট ভোপালের নবাব হামিদুল্লাহ খান অনেকটা ধর্মসংকটেই পড়ে গিয়েছিলেন দেশভাগের সময়। মুসলিম লীগের এক নেতা যেমন ছিল তাঁর বন্ধুস্থানীয়, তেমনই অন্যদিকে মাউন্টব্যাটেন ছিল তাঁর শৈশবের বন্ধু। নবাব হামিদুল্লাহ খান প্রথম থেকেই কংগ্রেসের নীতির বিরোধিতা করে এসেছিলেন। তাঁর ইচ্ছেও ছিল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার। তবে সমস্যা বাঁধে অন্য জায়াগায়। নিজের সিদ্ধান্তের পরও বাল্যবন্ধু লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে চিঠি লিখে পরামর্শ চান নবাব হামিদুল্লাহ। প্রত্যুত্তরে মাউন্টব্যাটেন ভারতে যোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। মাউন্টব্যাটেনের এই সিদ্ধান্ত ভোপালের সাধারণের মধ্যে জানাজানি হলেই চাপ বাড়তে থাকে তাঁর ওপর। পাশাপাশি অখণ্ড ভারতের বেশিরভাগ প্রিন্সলি স্টেট ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় তিনিও সেই পথেই হাঁটেন। ইচ্ছে পরিবর্তন করে স্বাধীনতার ঠিক আগের মাসেই ভারতের খাতায় নাম লেখান তিনি।

কাশ্মীরে দীর্ঘ একশো বছরের রাজত্ব ছিল হিন্দু রাজাদের। তবে জম্মু এবং লাদাখ বাদ দিয়ে কাশ্মীরের অধিকাংশ অঞ্চলেই মুসলিম আধিক্য বেশি। ১৯২৫ সাল থেকে স্বাধীনতার আগে অবধি কাশ্মীরের রাজা ছিলেন হরি সিং। দেশভাগের সময় মহারাজ গুলাব সিং সিদ্ধান্ত নেন, স্বতন্ত্র রাজ্য হিসাবেই থাকবে কাশ্মীর। তবে ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের অধিবাসীরা কাশ্মীর আক্রমণ করলে ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মাউন্টব্যাটেনের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন তিনি। কাশ্মীর ভারতভুক্তির পক্ষে চুক্তিতে সই করবে, এমন শর্তেই মাউন্টব্যাটেন রাজি হয়েছিলেন সাহায্য করতে। ২৫ অক্টোবর তিনি ভারতভুক্তির পক্ষে সইও করেন চুক্তিতে। ১৯৪৮ সালে কাশ্মীরে সেনা পাঠায় ভারত। অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধ চলে। ১৯৫২ সালে কাশ্মীরে একটি গণভোটের মাধ্যমে পুনরায় ঠিক হয় ভারতভুক্তির কথা। তবে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের ফলে পুরোপুরি ভারতভুক্তি হয়নি কাশ্মীরের। সেই দ্বন্দ্ব চলছে আজও।

তবে এখানেই শেষ নয়। আজকের ভারতের চেহারা এসেছে এর পরেও নানান বদল এবং সংযুক্তিকরণের মধ্যে দিয়ে। ব্রিটিশ শাসকরা ভারত থেকে বিদায় নিলেও কিছু অংশে পর্তুগিজ উপনিবেশ রয়েই গিয়েছিল ভারতে। তেমনই একটি রাজ্য গোয়া। স্বাধীনতার প্রায় ১৪ বছর পরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে হেরে গিয়ে উপনিবেশ ত্যাগ করে পর্তুগিজরা। ১৯৬১ সালে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয় গোয়া কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসাবে। আরও পরে রাজ্যের মর্যাদা পায় গোয়া। একইরকম ভাবে ভারতীয় ইউনিয়নে ১৯৭৫ সালে সংযুক্ত হয়েছিল ভারতের একমাত্র অর্গানিক রাজ্য সিকিম। ১৯৪৮ সালে মায়ানমারের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারতে সংযুক্ত হয়েছিল নাগাল্যান্ডও। তবে শর্ত ছিল স্বায়ত্বশাসনের। নাগাল্যান্ডের অধিবাসীরা খানিকটা বিচ্ছিন্ন থাকতেই পছন্দ করতেন অন্যান্য জনগোষ্ঠীর থেকে। অসমের অন্তর্গত হয়েই দীর্ঘদিন অস্তিত্ব ছিল নাগাদের। স্বাধীনতার ১৫ বছর পর ১৯৬৩ সালে ভারতে পৃথক রাজ্য হিসাবে স্বীকৃতি পায় নাগাল্যান্ড।

তাই বলাই বাহুল্য, ১৯৪৭ এর পরেও অনেক ভাঙা-গড়ার মধ্যে দিয়েই গেছে মাতৃভূমি। সেই পুনর্গঠন আজও চলছে অবিরত। রাজ্য ভেঙে গড়ে উঠছে নতুন রাজ্য। তবে বৈষম্যের মধ্যেও ঐক্য নিয়েই বিরাজমান আজকের ভারত। যে স্বপ্ন দেখেই লড়াইয়ের পথে নেমেছিলেন বহু বহু মানুষ, তুলে নিয়েছিলেন বিদ্রোহীর তকমা...

Powered by Froala Editor

More From Author See More