স্বাধীন ভারতে দরকার শিল্পোন্নয়ন, নেহরুর উদ্যোগেই শুরু রয়্যাল এনফিল্ডের পথ চলা

১৯৪৭ সাল। দেশভাগ, স্বাধীনতা, ক্ষমতার হস্তান্তর। একটু একটু করে গুছিয়ে নিচ্ছে একটা দেশ। বদল আসছে সবকিছুতেই। সেনাবাহিনীতেও। গোরা সৈন্যদের আধিপত্য নয়। এবার থেকে দেশের সীমান্ত রক্ষার কাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই করবেন ভারতীয় জওয়ানরা। তবে একশো নব্বই বছরের উপনিবেশ থেকে তো সবকিছু নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় ব্রিটেনে। ঠিক সেভাবেই ভারতে অস্ত্রশস্ত্রের সঙ্গেই ইংরেজরা ছেড়ে গিয়েছিল সামরিক যান ও সেনাদের জন্য বিশেষ যানবাহন। সবকিছুতে পরিবর্তন এলেও, একই রয়ে গেল সেসব।

১৯৪৭ সালের পর থেকে বেশ কিছু বছর ব্রিটিশদের ছেড়ে যাওয়া মোটরসাইকেলেই সীমান্তে টহল দিয়েছেন ভারতীয় সেনা। তবে ট্রায়াম্প বা বিএসএ-র মতো কোম্পানির তৈরি সেইসব মোটরবাইক প্রায়শই সমস্যায় ফেলত সেনা আধিকারিকদের। বয়স হওয়ার কারণে যেমন তারা জীর্ণ এবং পিছিয়ে পড়া প্রযুক্তির; তেমনই সংস্করণ এবং চালানোর খরচও ছিল আকাশছোঁয়া। যান্ত্রিক সমস্যা লেগেই থাকত নিত্যদিন। সেইসঙ্গে এইসব মোটরবাইকের যন্ত্রাংশও সেসময় ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে পাওয়া দুর্লভ।

সমস্যার সমাধানেই ভারতীয় সেনার তরফে ৫০০টি বুলেট মোটরবাইকের অর্ডার গেল মাদ্রাজে। মাদ্রাজ মোটরস-এ। স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত এই মাদ্রাজ মোটরস মারফতই নিজেদের ব্যবসা চালিয়ে গিয়েছিল রেডিচের বিখ্যাত ব্রিটিশ কোম্পানি ‘দ্য এনফিল্ড সাইকেল কোম্পানি লিমিটেড’। ৫০০টি দু-চাকার সেই যান ভারতে এসে হাজির হল এক বছর বাদে, ১৯৫৩ সালে। ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত রেডিচের সেই কোম্পানির তখন নাম ডাক শীর্ষে। ইতিমধ্যেই বিশ্বযুদ্ধের সময় তাদের তৈরি বাইক নিয়েই ইউরোপ মাত করেছে ব্রিটিশ সেনারা। ১২৫ সিসির সেই বাইক, ‘ফ্লাইং ফ্লি’ যেন সত্যিই উভচর। একদিকে যেমন পাথুরে পথ, অগভীর নদী অতিক্রম করার ক্ষমতা এবং দৃঢ়তা থাকত বাইকে; তেমনই বাড়তি কিছু যন্ত্রাংশের মাধ্যমে জুড়ে দেওয়া হত প্যারাসুট। আকাশ থেকে প্যারাট্রুপাররা সেই বাইক নিয়ে বিমান থেকে ঝাঁপ দিতেন রণক্ষেত্রে।

আরও পড়ুন
জাদু করে মঞ্চে ‘হাজির’ করতেন নিরুদ্দেশ নেতাজিকে, চোখ বেঁধে বাইক চালিয়েছেন কলকাতার রাস্তায়

বলাবাহুল্য, আমদানিকৃত বাইকগুলির কার্যকারিতা ভারতীয় সেনাদের কাছে ছিল প্রত্যাশাতীত। কাজেই বছর দুয়েকের মধ্যেই পুনরায় মোটরসাইকেলের প্রয়োজন পড়লে এনফিল্ডে ব্যবহারকারী ভারতীয় সেনাদের তরফে সরকারকে প্রস্তাব দেওয়া হয় ব্র্যান্ড অপরিবর্তিত রাখার জন্য। কিন্তু বিপুল পরিমাণে এই বাইক আমদানি করা ভারতের অর্থনীতির পক্ষে বেশ খরচ-সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ভাবলেন বিকল্প পথের কথা। 

যদি ভারতেই এমন যান তৈরি করা যায়? একই সঙ্গে তবে মিটে যাবে অনেকগুলি সমস্যাই। প্রথমত, কর্মসংস্থান হবে ভারতীয়দের। দ্বিতীয়ত, বিদেশ থেকে আমদানির খরচ থাকবে না কোনো। সেইসঙ্গে ব্যবসার মুনাফাও ব্রিটেনে না গিয়ে সংযোজিত হবে ভারতের আয়ের খাতে। যেমন ভাবনা, তেমনই কাজ। ১৯৫৫ সালে ভারত সরকারের তরফ থেকেই প্রস্তাব গেল রেডিচে। 

আরও পড়ুন
পেরিয়ে গেছে শতবর্ষ, এখনও রাস্তা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই বাইক

গৃহীত হল প্রস্তাব। ব্রিটিশ ব্র্যান্ড এনফিল্ডের থেকে লাইসেন্স কিনেই ভারতে শুরু হল স্বাধীন কারখানা। মাদ্রাস মোটরসের প্রতিষ্ঠাতা কে.আর. সুন্দরম আইয়ার এবং তাঁর ভাইপো কে. এস্বরনের দৌলতেই শুরু হল ‘এনফিল্ড ইন্ডিয়া’র পথ চলা। ১৯৫৬ সালের শেষদিকেই মাদ্রাসের উত্তরের তিরুভুতিয়ার সেই কারখানা থেকেই প্রথম তৈরি হল ১৬৩টি মোটরবাইক। তবে সেই বাইকের জন্য সমস্ত যন্ত্রাংশই এসেছিল বিদেশ থেকে। তারপর আরও কয়েক বছরের অপেক্ষা। অবশেষে ১৯৬২ সালে মাদ্রাজ মোটর বাস্তবায়িত করল প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘদিনের স্বপ্নকে। সম্পূর্ণ ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ মোটরবাইক। সেনাবাহিনীর ব্যবহারের কথা চিন্তা করেই নাম রাখা হয়েছিল ‘বুলেট’।

আরও পড়ুন
রাতের কলকাতায় ছুটে চলেছে জর্জ বিশ্বাসের 'পক্ষীরাজ' বাইক

ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে জনপ্রিয়তা। মজবুতি এবং ইঞ্জিনের ভারবাহী ক্ষমতার জন্য এই বাইক সেনাবাহিনী ছাড়াও ব্যবহার করতে শুরু করলেন স্থানীয় পণ্যবিক্রেতারা। বিশেষ করে দুধওয়ালা বা ফার্ম মালিকরা। সত্তরের দশকে প্রথম ভারত থেকে ইউরোপে রপ্তানি হয় এনফিল্ড ইন্ডিয়ার তৈরি বাইক। অবিশ্বাস্য কম দামের জন্য বিক্রিতেও খামতি ছিল না কোনো।

তবে সবকিছুরই উত্থান-পতন থাকে। তেমনই আশির দশকের শুরুতে হঠাৎ করেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল স্বাধীন ভারতের প্রথম মোটরবাইক নির্মাণ কারখানা। একদিকে কমতে থাকা বিক্রি যেমন শমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তেমনই প্রাকৃতিক দুর্যোগেও নাজেহাল হয়ে গিয়েছিল এনফিল্ড। মন্দা কাটাতে ১৯৯৪ সালে দিল্লির কোম্পানি এইচার মোটরসের সঙ্গে জোট বাঁধে এনফিল্ড ইন্ডিয়া। ‘রয়্যাল এনফিল্ড’ নামে নবজন্ম হল তার। পারতপক্ষে যা রেডিচের কোম্পানি ‘এনফিল্ড’-এর তৈরি শুরুর দিকের একটি মোটরবাইকের মডেলের নাম ছিল।

সংযুক্তিকরণের পরও দীর্ঘসময় রয়্যাল এনফিল্ডকে অপেক্ষা করতে হয়েছে দুঃসময় কাটার জন্য। ২০০২ সালে বন্ধ করতে হয়েছে জয়পুরের মোটরবাইক নির্মাণ ইউনিটও। তবে শূন্য দশকের শেষ থেকেই আবার মাথা তুলে দাঁড়ায় রয়্যাল এনফিল্ড। ফিরে পায় জনপ্রিয়তা। আবার শুরু হয় বৈদেশিক রপ্তানি। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ভারতের এই কোম্পানিকে। বর্তমানে বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশে রয়েছে রয়্যাল এনফিল্ডের গ্রাহক। প্রতি বছরই গ্রাহকের সংখ্যা সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে প্রায় ২০-৩০ শতাংশ করে। ২০১৫ সালে বৈশ্বিক বিক্রির সংখ্যার নিরিখে হার্লে ডেভিডসনকেও ছাপিয়ে যায় রয়্যাল এনফিল্ড। 

কে. এস্বরন 

 

‘ফৌজি’ আর ‘দুধওয়ালা’-র তকমা ছেড়ে বেরিয়ে এসে অধিকাংশ মানুষের কাছেই আজ স্টাইল স্টেটমেন্ট হয়ে গেছে রয়্যাল এনফিল্ডের মোটরবাইক। হয়ে গেছে ভারতের একটা আইকনিক যান। ‘মেড লাইক আ গান, গোস লাইক এ বুলেট’। প্রায় এক শতক আগের লেখা রেডিচের সেই ট্রেডমার্ক কখন যেন হয়ে উঠেছে সম্পূর্ণ...

তথ্যসূত্র-
১. Indian Icon — A Cult called Royal Enfield, Amrit Raaj
২. Royal Enfield India, Wikipedia
৩. The Enfield Cycle Company Limited, Wikipedia

Powered by Froala Editor

More From Author See More