জাদু করে মঞ্চে ‘হাজির’ করতেন নিরুদ্দেশ নেতাজিকে, চোখ বেঁধে বাইক চালিয়েছেন কলকাতার রাস্তায়

দিনটা ছিল ১৯৫১ সালের ২৮ মার্চ। কলকাতার রাস্তায় ছুটে যাচ্ছে একটা বাইক। আর শহরের লোকজন তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে আছে সেই দিকেই। অবাক হয়ে দেখছেন সেই আশ্চর্য দৃশ্য। কলকাতার রাস্তায় বাইকে নতুন কিছু নয়। তাহলে? তবে এক্ষেত্রে আশ্চর্য হওয়ার আছে বইকি। কারণ বাইকটি যিনি চালাচ্ছেন তাঁর দুটি চোখ তুলো, ময়দা, ব্যান্ডেজ দিয়ে বাঁধা। নিজে হাতে বেঁধে দিয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না তো? আশঙ্কা সকলেরই।

তবে সকলকেই অবাক করে দিয়ে কলকাতার জনবহুল রাস্তায় পুলিশের ট্রাফিক সিগনাল মেনে নিখুঁতভাবে আবার ফিরে এলেন সেই ব্যক্তি। তৈরি করলেন বিশ্ব রেকর্ড। এই ব্যক্তি আর কেউ নন, প্রখ্যাত জাদুকর জাদুসূর্য দেবকুমার। তবে কলকাতার রাস্তায় এই অবিশ্বাস্য খেলা দেখানো সহজ ছিল না তাঁর পক্ষে। পিছনে ছিল প্রশাসনিক বেড়াজাল।

প্রাথমিকভাবে জাদুকর দেবকুমার কলকাতায় খেলাটি দেখাতে চেয়েছিলেন ১৪ আগস্ট, ১৯৫০ সালে। তবে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার সত্যেন চ্যাটার্জ্জী অসম্মত হন তাঁকে অনুমতি দিতে। জাদুকর দ্বারস্থ হলেন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে। তবে মুখ্যমন্ত্রীর ফোনেও গলেনি সেই বরফ। পুলিশ কমিশনার অকপট জানিয়েছিলেন, এই খেলার জন্য যানজট বা কোনো গোলযোগ হলে শহরের ট্রাফিক কন্ট্রোলের দায়িত্ব নিতে হবে মুখ্যমন্ত্রীকেই। তবে অন্যকোনো শহরে জাদুকরের এই অভিজ্ঞতা থাকলে তাঁকে ছাড়পত্র দেবেন তিনি।

বিধান চন্দ্র রায় চোখ বেঁধে দিচ্ছেন জাদুসূর্যের

 

অবশেষে ব্যারাকপুর মহকুমার এসডিওকে সমস্ত ঘটনা জানিয়ে, তাঁর থেকে অনুমতি আদায় করেন জাদুসূর্য দেবকুমার। ১৯৫০ সালের ১৮ আগস্ট ব্যারাকপুর আদালত চত্বর থেকে বেলা আড়াইটের সময় শুরু করলেন তাঁর সেই থার্ড আইয়ের প্রদর্শনী। মহামান্য এসডিও এবং এসডিপিও দু’জনে ময়দা, তুলো, প্যাড, ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে দিলেন জাদুকরের দুটো চোখ। দেবকুমার সারা শহরের বাজার, বাধা, ট্রাফিক সিগনাল সবকিছু নিখুঁত ভাবে পেরিয়ে আবার কোর্ট প্রাঙ্গণে ফিরে আসেন। তাঁর এই অসামান্য কৃতিত্বে ও সাফল্যে এসডিও  উচ্চপ্রশংসা করে একটি পত্র লিখলেন। পরবর্তীকালে সেই চিঠি দেখেই অনুমতি দিয়েছিলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার। 

বলাই বাহুল্য তাঁর এই কৃতিত্ব ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি করেছিল তৎকালীন সমাজে। পেয়েছিলেন জনগণের অসংখ্য অভিনন্দন ও ভালবাসা। সেসময় আমাদের মত যুবকদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। পরে তিনি ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছোটো-বড়ো শহরের রাস্তায় চোখ বাঁধা অবস্থায় বাইক ও জিপ গাড়ি চালিয়েছেন। অনেকসময় সাধারণ মানুষ নানাভাবে পরীক্ষা করে দেখেছেন তাঁর এই ক্ষমতাকে। সব প্রশ্নেরই জবাব দিয়েছেন তিনি। বেঞ্চ, ঠেলাগাড়ি, বাঁশ ফেলে রাখা, রাস্তায় শুয়ে পড়া প্রভৃতি নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে মানুষ। তবে তাতে কোনো অসুবিধা হয়নি দেবকুমারের।

আরও পড়ুন
মৃত্যুশয্যাতেও ফেরাননি পিসি সরকারকে, হাসপাতালে শুয়েই জাদু দেখালেন সুশীলকুমার

ভারত বিভিন্ন সময়ে জন্ম দিয়েছে অনেক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বদের। তেমনই একজন জাদুসূর্য দেবকুমার। যিনি জন্মগত ঐশ্বরিক ক্ষমতা নিয়েই জন্মেছিলেন। পূর্ববঙ্গে যশোর জেলায় ইটনা গ্রামে ১৯২৩ সালে ২৮ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন দেবকুমার ঘোষাল। পিতা দুর্গাদাস ঘোষাল ও মাতা সুরেশ্বরী দেবী। জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন তাঁর জন্ম হয়েছিল বলে, দিদিমা তাঁর নাম দিয়েছিলেন দেবকুমার। চার ভাইয়ের মধ্যে দেবকুমার ছিলেন মেজো। অতি অল্পবয়স থেকেই শরীরের প্রতি যত্নশীল ছিলেন দেবকুমার। ছিল উজ্জ্বল মুখশ্রী। নিয়মিত শরীরচর্চার সঙ্গে ছোরা খেলা, লাঠি খেলা, যুযুৎসু, দীর্ঘক্ষণ হাঁটা ইত্যাদির মাধ্যমে শরীর সুস্থ রাখার চেষ্টা করতেন তিনি। 

বালক দেবকুমারের জাদুর প্রতি আকর্ষণ বাড়ে স্কুলে মণীন্দ্র ব্যানার্জ্জীর জাদু দেখে। পিতার অনুরোধে জাদুকর মণীন্দ্র ব্যানার্জ্জী বালক দেবকুমারকে কিছু জাদু শেখান। বালক দেবকুমারের একনিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে কিছু খেলাও উপহার দেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই বালক দেবকুমার বিভিন্ন পশুর স্বর নকল করতে পারতেন। স্বরক্ষেপণ বা ভেন্ট্রিলোক্যুইজমের মাধ্যমে বন্ধুদের সঙ্গে মজাও করতেন তিনি। 

পিতার অনুপ্রেরণায় ১৯৩৬ সালের মার্চ মাসে তিনি বরাহনগরের রাধা-গোবিন্দ জীউর ঠাকুরবাড়িতে যান। সেখানে জাদুগুরু গণপতি চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। গণপতি চক্রবর্তী তাঁকে সিক্রেট আর্ট শেখাতে রাজি হননি। এত ছোটো বয়সে এই কৌশল শিখতে গেলে ক্ষতি হতে পারে। 

আরও পড়ুন
চোখের দিকে তাকালেই নিশ্চিত অজ্ঞান; জাদুকর এসি সরকার-কে নিয়ে শোনা যেত এমনই

বালক দেবকুমার এবং তাঁর বাবার অনুরোধে কয়েকটা খেলা দেখাতে রাজি হলেন গণপতি চক্রবর্তী। দেবকুমারও কয়েকটি খেলা দেখালেন গণপতি চক্রবর্তীকে। তবে বালক দেবকুমারের নিপুণ হাতের কাজ দেখে বেজায় খুশি হলেন তিনি। অতঃপর রাজি হয়ে গেলেন বালক দেবকুমারকে কিছু খেলা শেখাতে। দেবকুমার জাদুগুরু গণপতি চক্রবর্তীর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন ৪ বছর। ১৯৩৯ সালে ২০ নভেম্বর গণপতিবাবু ইহজগতের মায়া ত্যাগ করেন। 

দেবকুমারের সৌভাগ্য হয়েছিল গণপতি চক্রবর্তীর মঞ্চ প্রদর্শনী দেখার। গুরুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গুরুর প্রদর্শিত পথেই জীবনযাত্রা শুরু করেন তিনি। ভারতীয় জাদুকরদের মধ্যে বালক জাদুকর নামে খ্যাতি ছিল তাঁর। বালক অবস্থাতেই দেবকুমার রীতিমত চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন জাদুবিদ্যার মাধ্যমে। বালক দেবকুমার ১৯৩৬ সালে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির অন্দরমহলেও জাদু দেখিয়েছিলেন। বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী বাসন্তী দেবী তাঁর জাদু দেখে মুগ্ধ হয়ে একটি পদক উপহার দিয়েছিলেন তাঁকে। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘এই বালক জাদুকর একদিন জাদুকে ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে চায়, তবে আমি ওকে সাহায্য করব। এ একদিন দেশের সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখে প্রতিষ্ঠিত হবেই।’ 

আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি খেলা দেখাচ্ছেন বালক দেবকুমার

 

আরও পড়ুন
কঙ্কাল বদলে যেত আস্ত নারীদেহে! বাংলার জাদু-জগতের পথিকৃৎ গণপতি চক্রবর্তীর খেল এমনই

 

এইভাবেই তিনি বহু ব্যক্তির আশীর্বাদ পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন বিচারপতি চারুচন্দ্র বিশ্বাস, বিশিষ্ট সাহিত্যিক দীনেশচন্দ্র সেন, ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেন, অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক, বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীরা। 

দেবকুমারের নতুন ধরণের উপস্থাপনা এবং প্রদর্শনীর ভঙ্গির প্রশংসা করতে কেউ কুণ্ঠাবোধ করেননি। ১৯৫১ সালে নিউ এম্পায়ারে জাদুসূর্য দেবকুমার নিজস্ব বুদ্ধিমত্তার শ্রেষ্ঠত্ব এবং প্রতিভাবনী শক্তির পরিচয় রেখেছিলেন। জাদুবিদ্যায় তিনি এতটাই পারদর্শী ছিলেন যে,  ভৌতিক বাক্স বা ইল্যিউশন বক্সের খেলাটাতে তিনি ১০০০ টাকা বাজি রেখে খেলা দেখাতেন। এই ইল্যিউশন বক্সের খেলায় তিনি দেখাতেন ‘জাদুকরের পরিবর্তন’, ‘হাউ নেতাজি ডিসঅ্যাপিয়ার কমপিটিশন’ ইত্যাদি। এই খেলার সময় পোশাক পরিবর্তন বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল। মঞ্চের ওপর জাতীয় পতাকা হাতে জাতীয় পোশাক ধুতি ও পাঞ্জাবী পরে বাক্স থেকে যখন বার হতেন, তখন সত্যিই মনে হত নেতাজি যেন আবির্ভাব হয়েছেন।

যাত্রীসহ বাইক অদৃশ্য করে দেওয়ার খেলা

 

বৈদ্যুতিক করাতে তরুণী দ্বিখণ্ডিত করা, জাদুকরের শিরশ্ছেদ, গোস্ট হাউস, থার্ড-আই, ভীষ্মের শরশয্যা, হোয়াইট আর্ট থেকে ব্ল্যাক আর্ট, কৃপণের স্বপ্ন, চলন্ত মোটরবাইক যাত্রীসহ অদৃশ্য করা— এই খেলাগুলি তাঁর আবিষ্কার ও অসাধারণ প্রদর্শনভঙ্গির প্রমাণ রাখে। থার্ড-আইতে তিনি চোখ বাঁধা অবস্থায় মোটরবাইক এবং জিপ গাড়ি চালিয়েছেন।

১৯৪৮ সালে দেবকুমারকে ‘জাদুসূর্য’ উপাধিতে ভূষিত করেন তখনকার জাদু সংগঠন ‘উইজার্ড ক্লাব’। বহু গুণী মানুষ ছাড়াও অনেক রাজা-মহারাজা এবং তাঁদের রানিদের সামনে তাঁদের খাস মহলে তিনি তাঁর জাদুপ্রদর্শনী ‘মিরাকল অফ ইন্ডিয়া’ প্রদর্শিত করেন।

ভীষ্মের শরশয্যা

 

জাদুসূর্য দেবকুমার বিনয়ী, সদালাপি, নিরহংকারী, ব্যক্তিত্বপূর্ণ মানুষ ছিলেন। চিরকালই এই জাদুশিল্পী লোকচক্ষুর অন্তরালে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতে পছন্দ করতেন। তখনকার জাদুকরদের নানান সভাতেও উপস্থিত থাকতে পছন্দ করতেন না তিনি। একজন উচ্চশ্রেণীর জ্যোতিষীও ছিলেন দেবকুমার। অবসর সময়ে সেটার চর্চা করতেন তিনি।

দেবকুমারের জীবনসঙ্গিনী হাসিরানী দেবীও একজন বুদ্ধিদীপ্ত মহিলা। মহিমামণ্ডিত সদাহাস্যময় ব্যক্তিত্ব তাঁর। রাঁচির মধ্যবিত্ত পরিবারের এই সুন্দরীর মেয়ের সঙ্গেই বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল আত্মনির্ভরশীল ম্যাজিক পাগল সুন্দর বাঙালি যুবকের। বিবাহের পর হাসিরানী দেবী হলেন রানীহাসি দেবী। তাঁর চলাফেরায় ছিল পুরোদস্তুর বনেদিয়ানার ছাপ। 

রানীহাসি দেবী

 

জাদুসূর্য দেবকুমার থাকতেন বরাহনগরের কাছে আলম বাজারে। বাড়ির নাম ছিল ‘উইজার্ড হাউস’। রানীহাসি দেবী জাদুসূর্যের শুধু ঘরণী ছিলেন না, ছিলেন সুনিপুণা সহকারিণী এবং পার্টির একজন কর্মকর্ত্রী। তাঁর ম্যাজিকের জ্ঞানও ছিল সুগভীর। স্টেজ সাজানো, আলো ও রং-এর খেলা এসব ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন তিনি। অদ্বিতীয় মহিলা তিনি অবিচ্ছিন্নভাবে দেবকুমারের সাহায্য করে গেছেন। শেষ বয়সে অনাড়ম্বর জীবন অতিবাহিত করেছেন একসঙ্গে। জাদুসূর্য ৮৪ বছর বয়সে অস্তমিত হন ২১ ডিসেম্বর, ২০০৭ সালে। সে এক শীতের দিন। চারপাশ ঘিরে রেখেছে হালকা কুয়াশা। জাদুসূর্যের প্রয়াণে সূর্যও কি ঢাকা পড়েছিল সেদিন? রানীহাসি দেবী বর্তমানে অসুস্থ। নাহলে তাঁকে জিজ্ঞেস করা যেত...

অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor

More From Author See More