মানুষের হাড় দিয়েই তাক-লাগানো ভেল্কি, কলকাতা ভুলেছে মাদারি জাদুকর রহমতুল্লাকেও

জাদু যেমন একটা শিল্প। তেমনই জাদুকর হলেন একজন শিল্পী। তবে তাঁর পরিধি কি শুধুই বিনোদনের মাধ্যমের মধ্যে সীমাবদ্ধ? জাদুবিদ্যা যে সমাজের মূল সমস্যাগুলোকেও আলোড়িত করতে পারে, জাদুশক্তি যে হতদরিদ্রের ভরসা হয়ে উঠতে পারে, তা ভাবা খানিকটা হলেও দুঃসাধ্য। তবে এমন ঘটনাও ঘটেছিল খোদ কলকাতার বুকে।

যে সময়ের কথা হচ্ছে তখন কলকাতা ঘিঞ্জি হয়ে ওঠেনি এতটাও। গজিয়ে ওঠেনি মাল্টিপ্লেক্স, শুরু হয়নি মেট্রো। রাসবিহারীর মোড়ও তখন এতটাও জমজমাট নয়। অনেকটাই ফাঁকা। ষাট-সত্তরের দশক। ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট কলকাতা। সেখানের পথে-ঘাটে তখন রাজত্ব করতেন মাদারিরা। মাদারি বলতে যাঁদের সহজ কথায় আমরা বেদে-বেদেনী বলে বুঝি। কলকাতার এই রাস্তা-ঘাটেই বিভিন্ন জাদুর খেলা দেখিয়ে বেড়াতেন সেই যাযাবররা। 

মাদারিদের সম্বল ছিল কেবলমাত্র একটা থলে। বহু রঙের কাপড় দিয়ে তাপ্পি মেরে বানানো সেই থলেতে থাকত ছোটো খাটো খেলা দেখানোর জিনিস। আর থাকত মানুষের হাড়। সেই হাড়ের এমন ক্ষমতা ছিল যে হাতের মুঠোয় রাখা টাকা, বল যার ওপরেই তাকে ঘোরানো হলে তা অদৃশ্য হয়ে যেত। ছোটো ছোটো কাঠের বাটি, টাকা আর বল দিয়ে মজার খেলা দেখাতেন তাঁরা। আবার সেই বল অদৃশ্য হয়ে গিয়েই ফিরে আসত ধাতুর মূর্তিও। ঐ হাড় নাকি কোনো এক চণ্ডালের। কামরূপ কামাখ্যার শক্তিশালী তান্ত্রিকদের থেকে তা সংগ্রহ করে আনা। এমন কথা হামেশাই শোনা যেত মাদারিদের মুখে। বিরাট শক্তিসম্পন্ন সেই হাড়। 

জাদুবিদ্যায় পারদর্শিতার দিক থেকে দেখতে গেলে আধুনিক জাদুকরদের থেকে কোনো অংশে কম ছিলেন না তাঁরা। বরং তাঁদের খেলা দেখানো ছিল আরও কঠিন। চতুর্দিকে ঘিরে থাকা দর্শকদের মধ্যেও অবলীলায় হাত সাফাইয়ের কাজ করে ফেলতেন তাঁরা। ভারতের অন্যতম বিখ্যাত যেসব জাদুকরদের আমরা জানি, তাঁদের উত্তরসূরি ছিলেন এই অসামান্য বেদে-বেদেনীরা। আধুনিক জাদুর রঙ্গমঞ্চ খেলার পাশাপাশিই নানান রঙিন কাপড়ের সাজসজ্জা, বাদ্যযন্ত্রের মূর্ছনা দিয়েই দর্শকদের থেকে সংগ্রহ করে নেয় বাহবা। এই আতিশয্য ছিল না মাদারিদের খেলায়। কিন্তু এই মাদারিরা যদি আজ না থাকত তবে, আধুনিক ভারতীয় জাদু সম্পূর্ণ রূপই হয়তো পেত না। 

আরও পড়ুন
জাদু করে মঞ্চে ‘হাজির’ করতেন নিরুদ্দেশ নেতাজিকে, চোখ বেঁধে বাইক চালিয়েছেন কলকাতার রাস্তায়


এমনই এক মাদারি জাদুকর রহমতুল্লা। জাদুজগতের গুটিকয় মানুষ ছাড়া সকলের কাছেই বিস্মৃতির অতলে তাঁর নাম। জাদুবিদ্যার দৌলতেই অদৃশ্যভাবে সমাজকে যে নাচিয়ে দেওয়া যায় তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। 

“গিলি গিলি গিলি গিলি, লাগ ভেল্কি লাগ। 

আমায় ছাড়া সবাইকে লাগ, 

আরও পড়ুন
মৃত্যুশয্যাতেও ফেরাননি পিসি সরকারকে, হাসপাতালে শুয়েই জাদু দেখালেন সুশীলকুমার

গাছে লাগ পাতায় লাগ 

যে যেখানে আছে লাগ...”

এই মন্ত্র আউড়েই ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে খেলা দেখাতেন রহমতুল্লা। আর সেই আওয়াজ শুনেই জড়ো হত লোকজন। অবিশ্বাস্য এই খেলা দেখার আশায়। সাদা-কালো দিনের দক্ষিণ কলকাতায় একদিন এক গলিতে চাদর বিছিয়ে খেলা দেখাচ্ছেন রহমতুল্লা। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়ে থেকে শুরু করে সমস্ত বয়সের লোকরাই উপভোগ করছেন সেই খেলা। এমনভাবে ভূতুড়ে কায়দায় এক বাটির তলা থেকে অন্য বাটির তলাতে বল পাঠাচ্ছেন তিনি, যে তা দেখে কায়দাটা ধরার চেষ্টা করেও ঠাহর করতে পারছেন না কেউ। দর্শক যত খেলা মজা পাচ্ছে ততই যেন তাঁর আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে খেলা দেখানোর।

 তিনি হাওয়া থেকে ধরে আনছেন অনেককিছু। আবার হাওয়াতেই মিলিয়ে দিচ্ছেন সেসব অনায়াসেই। তা দেখে দর্শকরা খুশি হয়ে পেতে রাখা চাদরের ওপরেই দিয়ে যাচ্ছেন টাকা পয়সা। তবে তার পরিমাণ সামান্যই।

আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ম্যাজিক করেই জার্মানদের হারিয়েছিলেন জ্যাস্পার, আজও গোপন সেই কৌশল

এই মাদারি, যাঁরা পথে ঘাটে খেলা দেখাতেন। তাঁদের প্রধান সমস্যা ছিল, তাঁদের খেলা দেখে, মজা উপভোগ করেই বেশিরভাগ লোকই কেটে পড়তেন। পাল্টা কিছু অর্থ সাহায্য করার মানসিকতাও বহুদূর। অন্যদিকে বড়ো মঞ্চে বা সিনেমা হলে যখন প্রতিষ্ঠিত জাদুকরেরা খেলা দেখান তখন, তাঁরাই আগে থেকে টিকিট কেটে সেই সমস্ত খেলা দেখতে যান। 

খোলা মাঠে এভাবে খেলা দেখিয়ে যা রোজগার তাতে সতিই কি বেঁচে থাকা যায়? পথে পথে খেলা দেখিয়ে বেড়িয়ে পেট ভরত না বলেই মাদারিরা আজ অবলুপ্ত পৃথিবী থেকে। তাঁদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া পিছনে রয়েছে সাধারণ মানুষেরই অবহেলা। তাই মাদারিরা তাঁদের জাত ব্যবসা ম্যাজিক দেখানো ছেড়ে অধিকাংশই চলে গেছেন অন্য পেশায়। শুধুমাত্র পেটের দায়েই। কলকাতা তো দূরের কথা, গ্রাম মফস্বলেও তাঁদের দেখা পাওয়া দুর্লভ।

যাই হোক খেলা দেখানোর শেষে রহমতুল্লা দেখলেন, তাঁর আয় হয়েছে গোটা পঁচিশ টাকা। চাদর, টাকা, খেলার সরঞ্জাম থলেতে সব গুছিয়ে বাড়ির পথে এগোতে যাবেন তিনি। এমন সময় পিছন থেকে টান পড়ল তাঁর আলখাল্লায়। ছোট্ট এক বাচ্চার মৃদু কণ্ঠ, “জাদুওয়ালা, ও জাদুওয়ালা, তুমি একটু আমাদের বাড়িতে আসবে? খুব সামনেই আমাদের বাড়ি। তোমার যাবার পথেই...” কী ভেবেই যেন আদুরে শিশুটির মায়ামাখা ডাকে সাড়া না পারলেন না রহমতুল্লা। হাঁটা লাগেলেন তাঁর হাত ধরেই। 

আরও পড়ুন
ম্যাজিক করেই ‘প্রধানমন্ত্রী’-কে পদত্যাগ করিয়েছিলেন পি সি সরকার

দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরের সেই বাড়িটা একবারে ঝরঝরে। অবশ্য সেই বাড়ির থেকেও খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থা রহমতুল্লার নিজের। বাড়িতে ঢুকেই জাদুকর দেখলেন বিছানায় শুয়ে রয়েছেন এক রুগ্ন বৃদ্ধা। তাঁকে সেবা করছেন তাঁর বৃদ্ধ স্বামী। বাড়িতে ঢুকেই বাচ্চাটা ছুটে গেল সেই বৃদ্ধের কাছে, “দাদু, দাদু, তুমি একদম চিন্তা করো না। দেখো কাকে নিয়ে এসেছি আমি। উনি সব দুঃখ, অসুখ ভ্যানিশ করে দেবেন। উনি একজন জাদুওয়ালা...”

বাচ্চাটার কথা শুনে যেন খানিকটা ভরসা পেলেন বৃদ্ধ দম্পতি। রহমতুল্লা তাঁদের খেলা দেখানোর ছলেই শূন্য থলে দেখিয়ে সেখান থেকে একে একে কমলালেবু, পেয়ারা, মিষ্টি বার করে এনে টেবিলে রাখলেন। হাওয়া থেকে এনে দিলেন পাঁচ টাকা। তবে আত্মসম্মান থেকেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নিতে চাইলেন না সেসব। শেষমেশ তাঁদের রাজি করাতে রহমতুল্লা সাহায্য নিলেন ঈশ্বরের। বললেন, ভগবানই তাঁর মারফত পাঠিয়েছেন এই দান। এই ফল, মিষ্টি খেলে শরীরের উপকার হবে। জোর আসবে। ঈশ্বরের কথা শুনে কাজ হল তাতে। দুর্দিনেও তাঁদের মুখে সামান্য হাসি দেখে খুশি হলেন জাদুকর। বাচ্চাটির হাতে লজেন্স ধরিয়ে বেরিয়ে এলেন তিনি। 

মাদারিদের জীবনই ঘুরে বেড়ানো। এক জায়াগায় খেলা দেখিয়ে সেখান থেকে আরেক জায়গায় ছুটে চলা। আবার সেখান থেকে অন্যত্র। এর পর কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। উপার্জনের তাগিদ আর যাযাবর জীবন তাঁকে আবার ছুটিয়ে নিয়ে এসেছে কলকাতার সেই পাড়াতেই। তবে এইবার খেলা দেখিয়ে ফেরার পথেই চমকে উঠলে রহমতুল্লা। একি! তাঁর সামনে এ কে! সেই বৃদ্ধা না? এগিয়ে গিয়ে রহমতুল্লা জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছেন তিনি? চিনতেও পারলেন বৃদ্ধা। জানালেন, তাঁর দেওয়া ঈশ্বরের পাঠানো ফল খেয়েই সেরে উঠেছেন তিনি। 

না! শুধু জাদুকরেরাই আশ্চর্য করেন না সমসময়। কখনো কখনো তাঁদেরও আশ্চর্য হওয়ার অবকাশ থাকে বৈকি। বৃদ্ধার চোখে ঈশ্বরের দূত হয়ে ওঠাটাই তেমন অবাক করেছিল রহমতুল্লাকে। নিজস্ব জবানিতে এই ঘটনার উল্লেখ করেই রহমতুল্লা বলেছিলেন, নিছকই ঈশ্বরের নাম নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর যে সত্যিই এ ঐশ্বরিক ক্ষমতা নেই, স্বীকার করেছিলেন রহমতুল্লা। শূন্য থেকে ফল এনে দেওয়ার পুরো ব্যাপারটাই ছিল হাতের কায়দা। তবে কীভাবে দ্রুত সম্ভব হল আরোগ্য? 

সেই উত্তর খুঁজে পাননি রহমতুল্লা। তবে কি অজানা শক্তিরই অধিকারী ছিলেন তিনি? তা হয়তো নয়। মনোবিজ্ঞানের দিক থেকে দেখতে গেলে আসলে মন আর শরীর এই দুই-ই অবিচ্ছেদ্য। ঈশ্বরের কথাতেই হয়তো লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ভরসা পেয়েছিলেন সেই বৃদ্ধা। সেরে উঠেছিলেন অদৃশ্যকে পাশে পাওয়ার আশ্বাসেই। আজকে যখন একে-অপরকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময়। যেখানে ‘সহযোগিতা’, ‘সহমর্মিতা’ শুধুমাত্র শব্দবন্ধ হয়েই রয়ে গেছে কথায়। এই সময়ে দাঁড়িয়েও রহমতুল্লার সেই জবানি যেন নতুন করেই অসহায়তার পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেয়। রহমতুল্লা, রহমতুল্লার মতো হারিয়ে যাওয়া হাজার হাজার মাদারিদের অজান্তেই...

(অনুলিখন – শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়)

ছবি ঋণ - লেখক

Powered by Froala Editor

More From Author See More