ধ্রুপদী' ভাষার স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত বাংলা; আত্মবিস্মৃতি নাকি অবহেলা?

সাম্প্রতিক জাতীয় শিক্ষানীতি (এনইপি)-এর পটভূমিতে আরও একবার ‘হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া’ ইস্যুতে সরগরম হয়ে উঠেছে দাক্ষিণাত্যের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য তামিলনাড়ু। তার কারণ হল, সারা দেশেই অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাক্ট বা সরকারি ভাষা আইন লাগু করতে চললেও সেই তালিকা থেকে বাদ রাখা হয়েছে তামিলনাড়ুকে।

সরকারি ভাষাগুলির বিধি সংক্রান্ত আইনে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে যে, তামিলনাড়ু রাজ্য ব্যতীত বিধিগুলি সমগ্র ভারতে প্রসারিত হবে। বলা বাহুল্য, এই লড়াই সহজ হয়নি তামিল জনগণের জন্য। কিন্তু কোনও মতেই হিন্দি ভাষার দাদাগিরি মেনে নিতে রাজি ছিলেন না তাঁরা। হিন্দি ভাষার আগ্রাসন থেকে রেহাই পাওয়ার দাওয়াই হিসেবে মোক্ষম চাল ছিল তামিল সরকারের ‘দ্বি-ভাষা নীতি’। তামিল ভাষার পাশে পাশেই ইংরাজি ভাষাকে অষ্টম তফসিলের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তোলা হয়। বিপুল গণদাবির চাপে কেন্দ্র বাধ্য হয়েছিল এই দাবি মানতে।

সম্প্রতি জাতীয় শিক্ষানীতি কার্যকর করার ক্ষেত্রেও বিতর্কের ঊর্দ্ধে থাকতে পারেনি বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় সরকার। অভিযোগ উঠেছে দেশের মূল বৈচিত্র্যের জায়গাটা ভেঙে দিয়ে এক দেশ, এক জাতি, এক ভাষা তত্ত্বের দিকেই নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে ক্রমশ। কিন্তু সেখানেও বাদ সেধেছে তামিলনাড়ু। তীব্র প্রতিবাদ উঠে এসেছে রাজ্য থেকে। বস্তুত, এই হিন্দি ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাক্ষিণাত্যের এই রাজ্য নেতৃত্ব দিচ্ছে বললেও অত্যুক্তি হয় না।

কিন্তু শুধু এখানেই থেমে যাচ্ছে না বিতর্ক। তার কারণ হল, নতুন শিক্ষানীতিতে ঘোষিত ধ্রুপদী ভাষা সংক্রান্ত পড়াশোনার নীতি। এই শিক্ষা নীতিতে বলা হয়েছে, ছয়টি ধ্রুপদী ভাষায় পড়াশোনার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলে যাবে গোটা দেশে। এই ছয়টি ভাষার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সংস্কৃত, তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালায়লাম এবং ওড়িয়া ভাষা। এই ভাষাগুলি নিয়ে যে কোনও রাজ্য থেকে পড়াশোনা করার সুযোগ পাবেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এই নীতি প্রকাশের ফলে বিতর্ক উঠেছে যে, কোন যুক্তিতে ধ্রুপদী ভাষার তালিকায় নেই বাংলা?

তবে তারও আগে প্রশ্ন তোলা যায় যে, বিতর্ক তৈরি হলেও কেমন একটা প্রচ্ছন্ন নির্লিপ্ততাও দেখা গিয়েছিল বাঙালিদের তরফে। নইলে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলি যেখানে নিজের ভাষার উপর সামান্যতম আঁচ এলেও ফেটে পড়ে ক্ষোভে, সেখানে বিশেষ কোনো তাপ-উত্তাপ দেখা যায়নি পশ্চিমবাংলায়। ২০০৪ সালে তামিল ভাষাকে প্রথম ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে সেই তালিকায় ওড়িয়া অন্তর্ভুক্ত হয় ২০১৪ সালে। বিশেষ করে প্রতিবেশী রাজ্যের ভাষা এই স্বীকৃতি পাওয়ার পর থেকেই একটা মৃদু হলেও আওয়াজ উঠতে শুরু করে বাংলার পক্ষে। কিন্তু সেই দাবি মান্যতা পায়নি এখনও।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, কীসের ভিত্তিতে বা কোন মানদণ্ডে ধ্রুপদী ভাষা ঠিক করে নেওয়া হচ্ছে? জাতীয় শিক্ষানীতিতে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে একাধিক মাপকাঠি। যেমন ধ্রুপদী স্বীকৃতি পেতে হলে ভাষাকে অন্তত দেড় হাজার বছরের প্রাচীন হতে হবে। অতীতের সঙ্গে আধুনিক ভাষারূপে পার্থক্য থাকতে হবে অবশ্যই। এই ভাষায় উন্নত মানের সাহিত্য সৃষ্টির উদাহরণ থাকতে হবে। অন্য ভাষা থেকে প্রায় কোনও শব্দ ধার না করে থাকতে হবে সম্পূর্ণ নিজস্বতা।

আরও পড়ুন
১৪ মাসে আত্মহত্যা ১৩ কর্মীর, ছাঁটাইয়ের পথে আরও ২০ হাজার; খাদের কিনারায় বিএসএনএল?

বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং ভাষাবিদদের মধ্যে শুরু হয়েছে এই নিয়ে বিতর্ক। কেউ কেউ যেমন দাবি করেছেন ওড়িয়া ভাষা ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পেলে, সেই তালিকায় হেসেখেলে ঢুকে পড়তে পারে বাংলাও। এক্ষেত্রে বাঙালিদের প্রতি কেন্দ্রের বিদ্বেষের মনোভাবই প্রকাশ পেয়েছে বলে মত তাদের। অন্যদিকে আরেকদল বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন, কোনও ভাষা থেকে শব্দ নেওয়া হয়েছে বলে হয়তো বাদ রাখা হয়েছে বাংলাকে। কিন্তু এই আত্তীকরণ প্রক্রিয়া কখনোই একটি ভাষাকে ছোট করে না। বরং তার মধ্যে বৈচিত্র্য আনতে সাহায্য করে। এতে সেই ভাষায় অন্তর্লীন উদারতাটুকুই প্রকাশ পায়। তবে সেই কারণেই কি এই তালিকা থেকে বাদ পড়েছে উর্দুও? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা একেবারেই ব্যাকরণের ব্যাপার। এভাবে কোনও ভাষার ঐতিহ্য সমৃদ্ধি বাড়ানো বা লঘু করা যায় না।

সারা বিশ্বে বাংলা ভাষায় কথা বলেন প্রায় ২৫ কোটি মানুষ। একটি দেশের রাষ্ট্রভাষাই হচ্ছে বাংলা। বিশেষজ্ঞরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, বাংলা ভাষার মতো আর কোনও ভারতীয় ভাষা নিয়ে এত বেশি চর্চা হয় না বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বাংলা ভাষা ছাড়া আর কোনও ভারতীয় ভাষায় এত বেশি অনুবাদের কাজও হয়নি। সুতরাং বাংলা ধ্রুপদী তকমা পেল কি পেল না তাতে কিছু আসে যায় না।

এক্ষেত্রে একটা চেনা প্রবণতা কিন্তু চোখে পড়ছে, যেটাকে প্রতিক্রিয়া দেখানোর বদলে পাত্তা না দেওয়ার মনোভাব বলাই যায়। তাহলে বাঙালিরা নিজের ভাষার গরিমা নিয়ে আত্মবিস্মৃত? নাকি এতটাই আত্মবিশ্বাসী, যে অন্য কেউ সম্মান দিল কি দিল না তাতে কিছু যায় আসে না আর? সন্দেহটা থেকেই যায়। তাই উড়িয়া ভাষা যে দেড় হাজার বছরের পুরনো, তার স্বপক্ষে তারা দলিল পেশ করলেও তেমন কোনও উদ্যোগ কিন্তু নেওয়া হয়নি বাংলায়। বরং বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তুলে কেন্দ্রকে আক্রমণ করেছে রাজ্য সরকার। অর্থাৎ ঘুরেফিরে সেই রাজনীতিই চলে আসছে প্রথমের সারিতে।

আরও পড়ুন
পাবজি-ফৌজি চর্চা, রবীন্দ্রনাথ ও কিছু 'হযবরল'

তবে বিতর্ক যাই থাকুক, বাংলা ভাষার ঐতিহ্য নিয়ে কথা উঠলে কিন্তু সেটা আবেগের থেকেও বেশি যুক্তিকে আঘাত করতে বাধ্য। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, শরৎচন্দ্র থেকে সুনীল, শক্তি, উৎপল বা জয় গোস্বামী যে ভাষায় লিখে গিয়েছেন, যে ভাষায় কাজ করে গিয়েছেন সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক বা তপন সিনহা, ‘পদ্মানদীর মাঝি’ বা ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ লেখা হয়েছে যে ভাষায়, লেখা হয়েছে ‘ঘুনপোকা’ কিংবা ‘আবোল তাবোল’, সেই ভাষার ঐতিহ্য বা গুরুত্ব নিয়ে কোনও কথাই উঠতে পারে কি? বিশদে উল্লেখ না করলেও এই প্রসঙ্গে তাই দিন কয়েক আগে একটি নিউজ চ্যানেলে আলোচনায় এসে কেন্দ্রের শাসকদলের এক মুখপাত্র যেভাবে ‘বাংলার ঐতিহ্য নেই’ এটা প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগলেন, তা চোখে লাগার মতোই। বাঙালি জাত এবার সত্যিই বিরোধিতায় নামবে, নাকি চিরাচরিত স্বভাবগত ঔদাসীন্যে এগিয়ে যাবে কলার উঁচু করেই— সেটাই এখন দেখার।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
১৮ থেকে বেড়ে ২১, বিবাহের আইনি বয়স বাড়িয়েও কি রোখা যাবে প্রসবকালীন মৃত্যু?

More From Author See More