কেমন দেখতে গভীর সমুদ্রের পৃথিবী? মানচিত্র বুনছেন গবেষকরা

পৃথিবীর ৭১ শতাংশ অংশ জুড়েই বিস্তৃত রয়েছে সমুদ্র। কিন্তু নীলগ্রহের এই তিন-চতুর্থাংশ জলভাগের তলদেশের মানচিত্র আজও অধরাই থেকে গেছে মানুষের কাছে। এখনও পর্যন্ত মাত্র ২০ শতাংশ সমুদ্রের তলদেশের ম্যাপ প্রস্তুত হয়েছে সরকারিভাবে। মূলত, মাল্টিবিম ইকো সাউন্ডার নামক সোনারের সাহায্যেই সমুদ্রতলের গভীরতা পরিমাপ করেন মেরিন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এই পদ্ধতি একদিকে যেমন অত্যন্ত ধীর গতির, তেমনই তা ব্যয়বহুলও। তবে মানচিত্র তৈরির কাজের গতি বৃদ্ধির জন্য এবার এই পদ্ধতিতে বেশ কিছু বদল আনলেন গবেষকরা। যার দৌলতে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যেই হাতে চলে আসতে পারে সমুদ্রলোকের মানচিত্র।

স্বাভাবকভাবে পূর্ববর্তীতে পদ্ধতিতে ২০০ মিটার গভীর সমুদ্রের মানচিত্র তৈরিতে সময় লাগার কথা প্রায় ৩৫০ বছর। প্রযুক্তির ব্যবহারে সেই সময়সীমাকেই সংক্ষিপ্ত করে ফেলেছেন গবেষকরা। সোনারের পাশাপাশি বর্তমানে সমুদ্রের মানচিত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে স্যাটেলাইট ব্যাথিমেট্রি। যে পদ্ধতিতে গুগল ম্যাপ কাজ করে, সেই পদ্ধতিতেই চলছে সমুদ্রের তলদেশের মানচিত্র নির্মাণ। 

তবে স্যাটেলাইট ইমেজিং-এর মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশের ছবি সংগ্রহ করার মূল সমস্যা হল রেজোলিউশন। এই ধরনের ছবিতে প্রতি পিক্সেলের আয়তন হয় ৮ বাই ৮ কিলোমিটার। ফলত একটি পিক্সেলের মধ্যেই ঢুকে পড়ে সমুদ্রলোকে অবস্থিত আস্ত পাহাড়। কিন্তু অগভীর সমুদ্রে কিংবা সমুদ্রের যেসকল অংশগুলির ভৌগোলিক গঠন অনিয়মিত নয়, সেখানে অনায়াসেই প্রযোজ্য হতে পারে এই পদ্ধতিতে গৃহীত ছবি। 

২০১৭ সালে সমুদ্রতলের এই মানচিত্র প্রস্তুত করতেই বিশেষ প্রকল্প নেন বিজ্ঞানীরা— সিবেড ২০৩০। মূলত সোনার এবং স্যাটালাইট উভয় পদ্ধতির সংমিশ্রত রূপ হল সিবেড ২০৩০। কিন্তু কীভাবে একত্রে কাজ করছে দুটি ভিন্ন পদ্ধতি? গোটা পৃথিবীর জলভাগকে অসংখ্য ছোট ছোট বর্গাকার ক্ষেত্রে ভাগ করে নিয়েছিলেন গবেষকরা। অগভীর অঞ্চলে এই বর্গক্ষেত্রের প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় দেড় কিলোমিটার। আবার একেবারে গভীরতম অঞ্চলে ১০০ মিটার বাই ১০০ মিটারের ক্ষেত্র তৈরি করেন তাঁরা। প্রথমে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রাথমিক একটি চিত্র প্রস্তুত করে, তার ওপরে প্রতিস্থাপন করা হয় সোনারের মাধ্যমে গৃহীত বিস্তারিত তথ্য। আর তাতেই ঘটে যায় ম্যাজিক। যেখানে ২০১৭ সালের আগে মাত্র ৬ শতাংশ সমুদ্রতলের মানচিত্র আয়ত্তে ছিল গবেষকদের, বিগত পাঁচ বছরের গবেষণায় তা গিয়ে দাঁড়ায় ২০.৬ শতাংশে। এই গতিতে কাজ চলতে থাকলে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যেই মানুষের হাতে চলে আসবে গোটা সমুদ্রলোকের মানচিত্র।

আরও পড়ুন
সূর্যালোকেই বিয়োজন প্লাস্টিকের, যুগান্তকারী আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের

এখনও পর্যন্ত এই বিশেষ গবেষণার সঙ্গে জড়িয়ে গোটা বিশ্বের মাত্র দুটি বিজ্ঞান সংস্থা। নিপ্পন ফাউন্ডেশন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিকেড অফ ওসান সায়েন্স ফর সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট। তবে গবেষণার গতি বাড়াতে বর্তমানে তৃতীয় মাধ্যমের সংস্থাদেরও দ্বারস্থ হয়েছেন সংশ্লিষ্ট গবেষকরা। আসলে নৌবাহিনী, পেট্রোলিয়াম উত্তোলক সংস্থা এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক সংগঠন কর্মসূত্রেই সংক্ষিপ্ত মাত্রায় প্রস্তুত করে রাখে সমুদ্রের নির্দিষ্ট অংশের মানচিত্র। তাঁদের সেই অপ্রকাশিত ব্যাথিমেট্রিক তথ্যই গবেষণার কাজে ব্যবহার করতে চলেছেন গবেষকরা। ডেটা ক্লাইডে সেই বিস্তারিত তথ্য চলে এলে, সহজেই সাজিয়ে ফেলা যাবে বৃহত্তর একটি পাজেলের ছোট ছোট টুকরোগুলিকে। 

আরও পড়ুন
কতটা লবণ সইতে পারে ম্যানগ্রোভ? রহস্যভেদ ভারতীয় বিজ্ঞানীদের

কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য কতটা প্রয়োজনীয় এই গবেষণা? মূলত, সমুদ্রের তলদেশের গভীরতা এবং প্রাকৃতিক গঠনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় বাস্তুতন্ত্রের চরিত্রও। ফলে, সমুদ্রলোকের মানচিত্রে আয়ত্তে এলে, সহজ হবে সামুদ্রিক প্রাণীদের সংরক্ষণের কাজ। অন্যদিকে সুনামি কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আগাম আভাস পাওয়াও সম্ভব হবে আগামীদিনে। বোঝা যাবে পরিবর্তনশীল জলবায়ুর চরিত্র। এক কথায়, একাধিক অজানা রহস্যের সমাধান হতে পারে এই মানচিত্রকে হাতিয়ার করে। আর সেই কারণেই প্রোজেক্ট সিবেডকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা…

আরও পড়ুন
জ্যান্ত বিড়াল দিয়ে তৈরি টেলিফোন! চমকে দিয়েছিলেন দুই মার্কিন বিজ্ঞানী

Powered by Froala Editor