ভারতে আজও ভিক্ষাবৃত্তি ‘দণ্ডনীয় অপরাধ’, আইন বদলাতে নোটিস সুপ্রিম কোর্টের

রেলস্টেশন হোক কিংবা রাস্তা অথবা মন্দির— ভারতের যে কোনো প্রান্তে গেলেই দেখা মিলবে ভিক্ষুকের। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ভিক্ষাবৃত্তি দণ্ডনীয় অপরাধ কেন্দ্রশাসিত দিল্লি-সহ মোট ২২টি রাজ্যে। আইনত ৩ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ২০০০ টাকার জরিমানা পর্যন্ত হতে পারে ভিক্ষাবৃত্তির জন্য। তবে এবার বদলাতে চলেছে সেই আইন। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্র এবং বেশ কয়েকটি রাজ্যকে নির্দেশ দিল বিষয়টির পর্যালোচনা করে রিপোর্ট জমা দিতে।

চলতি শতাব্দীর প্রথম দশক থেকেই আইনজীবী হর্ষ মান্দার লড়াই চালিয়ে গেছেন ভিক্ষা প্রতিরোধ আইনের বিরুদ্ধে। দিল্লি আদালতে বার বার পেশ করেছেন আবেদনপত্র। কার্যত এই আইনের ব্যবহারে সচরাচর কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা না হলেও সাংবিধানিকভাবে বন্ধ করতে হবে এটিকে, এই ছিল তাঁর দাবি। সেই দাবিকে মান্যতা দিয়েই ২০১৭ সালে দিল্লি হাইকোর্ট বাতিল করে আইনটি। সেইসঙ্গে কেন্দ্র সরকারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আইন বাতিলের পর ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু খাতায় কলমেই থেকে যায় সেই প্রতিশ্রুতি। অন্যদিকে দিল্লিতে বাতিলের প্রক্রিয়াটুকু হলেও তার রেশ বিন্দুমাত্র পড়েনি ভারতের বাকি রাজ্যগুলিতে।

পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় কাউন্সিল বোর্ডের সদস্য মোনিকা অরোরা এবং হর্ষ আহুজা এক বিবৃতিতে জানান, কেন্দ্রের কাছে এই ধরণের কোনো আবেদন জমা পড়েনি। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় কোনো আইনেই ভিক্ষাকে ‘অপরাধ’ হিসাবে বর্ণনা করা হয় না। এই আইন বিভিন্ন রাজ্য সরকার প্রণোদিত। সুতরাং, রাজ্যগুলিকেই এগিয়ে আসতে হবে সমস্যা সমাধানে। অর্থাৎ, এক কথায় বলা চলে এই গুরুতর বিষয়টি থেকে অনেকটা গা বাঁচিয়েই চলছে কেন্দ্র।

পরিসংখ্যান দেখতে গেলে, শুধু দিল্লিতেই রয়েছেন ৫০ হাজারের বেশি ভিক্ষুক। তাঁদের ‘অপরাধী’ হিসাবে দেগে দেওয়া এক প্রকার মানবতার বিরুদ্ধাচরণ নয় কি? তাছাড়াও থেকে যায় আরও একটি বৃহত্তর প্রশ্ন। যদি ভিক্ষাবৃত্তি ‘অপরাধ’ হয়েই থাকে, তবে ব্যর্থতার ভাগীদার তো সরকারও। কারণ সংবিধান অনুযায়ী মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা এবং খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদ হিসাবে তাঁরা প্রত্যেকেই বঞ্চিত সেই মৌলিক অধিকার থেকে। 

দিল্লি হাইকোর্টের সেই মামলার ঠিক এক বছর পর ২০১৮ সালে আইনজীবী এইচকে চতুর্বেদী সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন রাজ্যগুলি থেকেই এই আইন তুলে নেওয়ার জন্য। ভিক্ষাবৃত্তিকে সাধারণত কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে যে বেছে নেয় না তাই, তুলে ধরেন চতুর্বেদী। ২০১১ সালের সেনসার অনুযায়ী তিনি পেশ করেন, সারা ভারতে ৪ লক্ষের বেশি মানুষ বাধ্য হচ্ছেন ভিক্ষাবৃত্তিকে বেছে নিতে। একদিকে যেমন স্থায়ী বাসস্থানের নেই তাঁদের, পাশাপাশি নেই কোনো কর্মসংস্থানও। এমন পরিস্থিতিতে যে কোনোভাবেই তাঁদের এই ‘জীবীকা’কে অপরাধ হিসাবে দেগে দেওয়া যায় না, তাই উঠে আসে তাঁর কথায়।

চতুর্বেদীর এই আবেদনেই সম্প্রতি সাড়া দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। পাঞ্জাব, বিহার, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা-সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে পাঠানো হয়েছে নোটিস। আগামী ছ’ সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তার যথাযথ উত্তর জমা দিতে বলেছে বিচারপতি অশোক ভূষণ এবং আর এস রেড্ডির ডিভিশন বেঞ্চ।

আরও পড়ুন
‘যৌন সেবাদাসী’দের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য জাপান সরকার, রায় দক্ষিণ কোরিয়া আদালতের

আর হয়তো কয়েক মাসের মধ্যেই বন্ধ হবে ১৯৫৯ সালের এই আইন। সরিয়ে নেওয়া হবে ভিক্ষুকদের থেকে ‘অপরাধী’-র দাগ। এমনকি মাস খানেক আগে রেলও আভাস দিয়েছে একই রকম পদক্ষেপের। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই আইন তুলে নেওয়াই কি শেষ কথা? আইন বাতিল করলেই কি সমস্যার সমাধান মিলবে? জানা নেই। অন্যদিকে সাংবিধানিক অধিকারের প্রসঙ্গ উঠে আসার পরেও কেন্দ্রের নীরবতা সমালোচনার মুখে। সারা ভারতের গৃহহীন এই চার লক্ষ মানুষের পুনর্বাসন কিংবা কর্ম সংস্থান নিয়ে আদৌ কি কোনো পদক্ষেপ নেবে সরকার? নাকি স্রেফ আইন বাতিল করেই দায় সারবে নিজেদের? এই প্রশ্নই ঘুরে ফিরে আসছে বার বার।

Powered by Froala Editor

More From Author See More