ছেড়ে গেছে অধিকাংশ মানুষ, মৃত্যুর অপেক্ষায় রাশিয়ার এই শহর

যতদূর চোখ যায় ধবধব করছে সাদা তুষারের আস্তরণ। পথের দুধারে জ্বলছে ম্রিয়মান ল্যাম্পপোস্ট। খানিক দূরেই খোলা রয়েছে একটা দোকান। বিক্রেতা থাকলেও দেখা নেই কোনো খরিদ্দারের। রাস্তাঘাটও জনশূন্য। মাঝে মধ্যে আওয়াজ করে চলে যাচ্ছে এক একটা ফাঁকা বাস। আর তার শব্দ প্রতিফলিত হচ্ছে বিশাল বিশাল অ্যাপার্টমেন্টগুলোও। তারাও ঢেকে গেছে বরফে। কেবলমাত্র দু-একটা জানলা থেকেই ঠিকরে আসছে আলোর রেখা। তাছাড়া দৈত্যাকার সেই বাড়িগুলো যেন পুরোটাই অন্ধকারের আস্তানা।

রাশিয়ার ভরকুটা শহরের ছবিটা এরকমই। আর্কটিক অঞ্চলে অবস্থিত এমন এক মায়াবী শহর যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরী। এই শহরেই একসময় ৩ লক্ষের বেশি মানুষের বসবাস ছিল। ক্রমশ কমতে কমতে বাসিন্দাদের সংখ্যা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। বর্তমানে সেখানে থাকেন খুব বেশি হলে হাজার পঞ্চাশেক বা তারও কম মানুষ। কিন্তু হঠাৎ কেন পরিত্যক্ত হয়ে উঠল এই শহর? সেই উত্তর খুঁজতেই ভরকুটায় অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন চিত্রসাংবাদিক ইরিনা সেডুনোভা। 

একটু ফিরে তাকানো যাক এই শহরের ইতিহাসের দিকে। ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলেই গড়ে উঠেছিল কুখ্যাত গুলাগ শ্রম শিবির। সেইসঙ্গে গবেষকরা ঠাহর করতে পেরেছিলেন ভরকুটার গর্ভে লুকিয়ে রয়েছে কয়লার এক বিশাল ভাণ্ডার। নদী নয়, কৃষিক্ষেত্র কিংবা শিল্পও নয়— কেবলমাত্র কয়লাখনিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠল এক আস্ত নগরী। তখনও অবশ্য নগরী হয়ে ওঠেনি ভরকুটা। সেখানে মূলত থাকতেন বন্দি ও সামরিক আধিকারিকরা। বন্দিদের দিয়েই চলত কয়লাখনন। অনেকটা দাসত্বপ্রথার মতোই। 

ষাটের দশকে বন্ধ হয়ে গেল সেই বন্দিশিবির। তবে কয়লা উৎপাদন তো থেমে থাকতে পারে না তার জন্য। ফলে প্রয়োজন পড়ল শ্রমিকের। কিন্তু এমন এক প্রান্তিক অঞ্চলে কাজ করতে কারাই বা এগিয়ে আসবেন? আর্কটিক অঞ্চলের এই শহরে যে দিনের দৈর্ঘ্য মাত্র ৩৮ মিনিট। তাপমাত্রা সারাবছরই থাকে হিমাঙ্কের নিচে। ডিসেম্বরে তা নেমে আসে –৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। কাজেই শ্রমিকদের আকর্ষিত করতে ধার্য হল উচ্চ বেতন। ব্যবস্থা করা হল বিশাল বিশাল বহুতল অ্যাপার্টমেন্টেরও।

আরও পড়ুন
এক শতকে ৩ বার নামবদল, রাশিয়ার পিটার্সবার্গকে নিয়ে কমতি নেই বিতর্কের

এরপর দ্রুতই বদলে গিয়েছিল ভরকুটার ছবি। সত্তর এবং আশির দশকে গম গম করত ভরকুটায়। প্রথমে শুধুমাত্র কাজ করার জন্য এলেও, পরে তাঁরাই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান এই শহরের। গড়ে ওঠে অত্যাধুনিক পথঘাট, পরিকাঠামো, শিক্ষা ব্যবস্থা, হাসপাতাল সবকিছুই। তবে আর সমস্যা কোথায়?

আরও পড়ুন
-৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও স্বাভাবিক জনজীবন, পৃথিবীর শীতলতম গ্রামের গপ্পো

গোলযোগ বাঁধল কিছুদিন পর থেকে। একুশ শতকের ঠিক আগে থেকে একে একে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে ভরকুটার কয়লাখনিগুলি। যেখানে ’৭০-এ সব মিলিয়ে ১৩টি কয়লাখনি ছিল এই অঞ্চলে, এখন সেই সংখ্যাটা এসে ঠেকেছে মাত্র ৪-এ। যার মধ্যে রাশিয়ার গভীরতম কয়লাখনি কমসোমলস্কায়া অন্যতম। তবে আর বছর দুয়েকের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে সেটিও। কারণ মাটির তলায় কয়লার ভাণ্ডার যে ফুরিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। 

যেভাবে কাজের আশাতেই মানুষেরা এসে বাসা বেঁধেছিলেন এই শহরে, ঠিক তেমনভাবেই ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়ে উঠছে এই নগরী। শহরের একটা বড়ো অংশের মানুষই যে নির্ভরশীল ছিলেন কয়লাখনিগুলির ওপরে। উপার্জন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা ছেড়ে যাচ্ছেন এই শহর। আর বাকিরা কোনোক্রমে এই প্রতিকূলতার সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছেন লড়াই। কিন্তু আর কতদিন? এই প্রশ্নই যেন ঘুরে ফিরে আসে বার বার। আগামী বছর পাঁচেকের মধ্যে বন্ধ হয়ে যেতে পারে আরও দুটি খনি। তারপর আরও জনশূন্য হয়ে যাবে ভরকুটার প্রান্তর। 

এই ধরনের পরিত্যক্ত শহর বা ঘোস্ট টাউনের ছড়িয়ে রয়েছে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তেই। তবে তা সবই মধ্যযুগীয় কিংবা তারও পুরনো। সেসব শহরের গল্প, পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়ার আখ্যানের দিকে উৎসুক হয়েই চেয়ে থাকেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। সাধারণ মানুষও। এখনও সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়ে যায়নি ভরকুটা। তবে সেই গন্তব্যেই এগিয়ে চলেছে সে। একটা অস্ত শহরের এই ‘পরিযায়ন’-ই যেন জীবন্ত দৃষ্টান্ত। পারতপক্ষে তার মধ্যে দিয়েই যেন প্রতিফলিত হয় অন্যান্য ঘোস্ট টাউনগুলির ইতিহাস…

Powered by Froala Editor

More From Author See More