জড়িয়ে দেশভাগের স্মৃতি; ৭০ বছর ধরে বিনামূল্যে খাবার যোগাচ্ছে ‘গরিব হোটেল’

পুরনো দিল্লির জামা মসজিদকে ঘিরে যে অসংখ্য গলি-রাস্তা চলে গিয়েছে, তাদেরই একটি ধরে কয়েক-শ মিটার এগোলেই পৌঁছে যাবেন রেহমাতুল্লহ হোটেল। পুরনো দিল্লির খাবারের দোকান যেমন হয়, তেমনই মানুষের ভিড়ে ঠাসা। আর তার মধ্যেই সুস্বাদু মাংস রান্নার গন্ধে চারিদিক ম ম করে উঠছে। সেই গন্ধ ধরে এগিয়ে হোটেলের সামনে দাঁড়ালেই অবাক হতে হয়। তার কারণ অবশ্য অন্যকিছু নয়। উত্তর ভারতের যে কোনো হোটেলেই ইংরেজি, হিন্দি এবং উর্দু ভাষায় নাম লেখা থাকবে, সেটা স্বাভাবিক। তবে এই তিনটি ভাষার পাশেই দেখবেন স্পষ্ট বাংলা হরফে লেখা হোটেলের নাম।

দিল্লি শহরের বুকে হঠাৎ বাংলা হরফ দেখে যতটা অবাক লাগবে, তার চেয়েও অবাক করা এই হোটেল। কারণ এখান থেকে কেউ অভুক্ত অবস্থায় ফিরে যান না। হ্যাঁ, খাবারের কোনো দাম দিতে না পারলেও পেট ভরে রুটি, বিরিয়ানি থেকে শুরু করে ফিরনি, রায়তা সবই পাওয়া যাবে এখানে। স্থানীয় মানুষদের মুখে মুখে তাই এই হোটেলের নাম হয়ে উঠেছে ‘গরিব হোটেল’।

বর্তমানে সামান্য থেকে সামান্যতম জিনিসের জন্যও টাকা খরচ করতেই হয়। বিনামূল্যে কিছুই পাওয়া যায় না। সেখানে রেহমাতুল্লহ হোটেলের এই চরিত্র অনুসন্ধান করতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে আরও সাড়ে সাত দশক। তখন ভারত সদ্য স্বাধীন হয়েছে। বলা ভালো, দেশভাগ হয়েছে। আর দেশভাগের অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসাবে হাজার হাজার মানুষ নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে চলেছেন অন্য বাসস্থানের সন্ধানে। মাথার উপরে ছাদ নেই, টাকা-পয়সা তো অনেক দূরের কথা। পাঞ্জাব এবং বাংলা থেকে উদ্বাস্তু মিছিল ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সব প্রান্তেই। ঠিক সেই সময়েই জামা মসজিদের ধারে তৈরি হয়েছিল এই হোটেল। সাধারণ ক্রেতারা নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়েই খাবার কিনবেন। কিন্তু উদ্বাস্তুদের কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়া হবে না। এমনটাই ঠিক করলেন হোটেলের মালিক। শুধু তাই নয়, উদ্বাস্তুদের একটা বড়ো অংশই ছিলেন বাঙালি। আর সেই কারণেই হোটেলের সাইনবোর্ডে হিন্দি, ইংরেজি, উর্দুর পাশাপাশি লেখা হল বাংলা হরফও।

স্বাধীনতার এত বছর পেরিয়েও আজও বহাল রয়েছে সেই নীতি। দেশভাগের ক্ষত অনেকটা মিলিয়ে এলেও অভাব আর দারিদ্র্য আজও ঘোচেনি। আর তাই রেহমাতুল্লহ হোটেলের দায়িত্বও ফুরোয়নি। হোটেল মালিকের পক্ষে তো আর সবার খাবার বিনামূল্যে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই চাইলে যে-কোনো সহৃদয় ব্যক্তি এগিয়ে এসে সাধ্যমতো অর্থসাহায্য করতে পারেন। এমনিতে খাবারের দাম বেশ কম। ১০০ টাকার মধ্যেই জমিয়ে ভুড়িভোজ সম্ভব। তাই খাবার শেষে অনেকেই একটি মিলের পরিবর্তে দুটি মিলের মূল্য দিয়ে যান। আবার স্থানীয় মানুষদের বিবাহ হলে বা বাড়িতে নতুন সন্তান জন্মালে অথবা কেউ চাকরি পেলেই কিছু অর্থসাহায্য করে যান ‘গরব হোটেল’-এ। দরিদ্র্য মানুষদের অন্তরের আশীর্বাদের খানিকটা ভাগ পেতে চান সকলেই। আর এভাবেই আজও পুরনো দিল্লির বুকে টিকে রয়েছে মানবিকতার এক আশ্চর্য মন্দির। এখানে এলে আর কেউ বলবে, আজকের পৃথিবীতে মনুষ্যত্ব বেঁচে নেই?

আরও পড়ুন
‘নিচু জাতের’ হওয়ায় খেতে পাননি হোটেলেও; ‘পদ্মশ্রী’ হয়েই জবাব দিলেন লাখা খান

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
মারাদোনার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মিউজিয়াম কেরালার হোটেলে