অসুস্থ রজনীকান্ত, কিডনি দেওয়ার জন্য আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন এক ভক্ত!

ব্যাঙ্গালোরের বিটিএস কোম্পানির বাসটি ছুটেছে রাস্তা দিয়ে। যাত্রী উঠছে, নামছে। জীবন চলেছে জীবনের মতো। তার মধ্যেই দাঁড়িয়ে চারিদিকটা দেখে নিচ্ছেন কনডাক্টর শিবাজি রাও গায়কোয়াড়। দারিদ্র্যের জীবন তাঁর; নানা জায়গায় ঘুরে ফিরে এই কনডাক্টরির জীবনে এসেছেন তিনি। মা চলে গেছেন সেই কোন ছোটবেলায়। যাত্রীরা ডাকছে, সঙ্গে সঙ্গে চলে যাচ্ছেন সেখানে। বাকি সময়টা মন পড়ে থাকছে অন্য জায়গায়। আর কতদিন এরকমভাবে চলবে? তাঁর মন যে আটকে আছে অভিনয়ের দিকে! রাস্তায় অ্যাকটিং ক্লাসের বিজ্ঞাপন দেখলেই চোখ চকচক করে ওঠে। শিবাজি রাও গায়কোয়াড়ের স্বপ্নে জেগে ওঠে আরেক সত্তা— যার নাম রজনীকান্ত…

মারাঠি পরিবারের ছেলেটি যখন রামকৃষ্ণ মিশনে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হলেন, তখনই নাটকের বিশাল জগত খুলে গেল তাঁর সামনে। মিশনের মঞ্চে সেই ছোট্ট বয়সেই একের পর নাটকে নামা। ভেতরে তখন তৈরি হচ্ছে নিজস্ব চিন্তা, সমাজের কথা। কিন্তু ভাগ্য বড়োই অদ্ভুত। সংসার চালানোর জন্য অল্প বয়সেই কাজে নেমে পড়লেন শিবাজি। কখনও কুলি হয়ে মোট বয়েছেন, কখনও কাঠের গুদামে কারপেন্টারের কাজও করেছেন। শেষে এই বাস কনডাক্টর। কিন্তু তিনি যে এই কাজের জন্য জন্মাননি! মাদ্রাস ফিল্ম ইন্সটিটিউটের হোর্ডিং দেখে ভেতরে ছটফট করে উঠত মনটা। সাহস যোগালেন বন্ধু রাজ বাহাদুর। কিন্তু অভিনয়ের ক্লাস করতে গেলে তো কনডাক্টরিতে সময় কমবে। মাইনেও হাতে আসবে কম। রাজ বাহাদুর নিজের পকেট থেকে টাকা ধরিয়ে দিলেন শিবাজি গায়কোয়াড়ের হাতে। তোমাকে একদিন বিশাল হতে হবে। তুমি এগিয়ে যাও স্বপ্নের দিকে… 

শিবাজি গায়কোয়াড় থেকে রজনীকান্ত হওয়ার যাত্রার এই শুরু। এই সত্তর বছর বয়সে এসে আসল নামটি বোধহয় ভুলেই গেছেন তিনি। আসমুদ্রহিমাচলের কাছে তাঁর পরিচয় একটাই— ‘রজনীকান্ত দ্য থালাইভা’। কি না পারেন তিনি! শূন্যে সিগারেট ছুঁড়ে জ্বালিয়ে দিতে পারেন; তাঁর মানিব্যাগ হারিয়ে গেলে দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা যায়; স্রেফ দাঁত দিয়েই ছুটে আসা বুলেট থামিয়ে দিতে পারেন তিনি। আরও কত ক্ষমতা তাঁর। আর হবে নাই বা কেন, তিনি যে ‘ভগবান’! দক্ষিণ ভারতে গেলে রজনীকান্তের এমন রূপই দেখতে পাবেন সবাই। রাজা বৃদ্ধ হলেও, রাজা তো! 

১৯৭৫ সাল। কে বালাচন্দরের সিনেমা ‘অপূর্ব রাগাঙ্গাল’-এ প্রথমবার দেখা যায় এই শ্যামলা রঙের ছেলেটিকে। বিপরীতে শ্রীবিদ্যা, এক অত্যাচারী স্বামীর ভূমিকায় অভিনয় করলেন নবাগত রজনীকান্ত। হ্যাঁ, শিবাজি রাও গায়কোয়াড়ের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন ততদিনে। প্রথম সিনেমাই পেল জাতীয় পুরস্কার। নিজে না পেলেও, রজনীকান্তের অভিনয় ক্ষমতা সাড়া ফেলে দিল সব জায়গায়। সময় যত এগিয়েছে, ততই ধারালো হয়েছেন তিনি। ছবি কখনও হিট করেছে, কখনও মুখ থুবড়ে পড়েছে। রজনীকান্ত তখন কেবল একজন ভালো, প্রতিভাবান অভিনেতা; ‘বৈরাভি’, ‘আরিলিরুন্থু আরুবাথু ভারাই’-এর মতো সিনেমায় নিজের জাত চিনিয়েছেন। ১৯৮০-এর ‘বিলা’ রীতিমতো বক্স অফিস সফল ছবি। রজনীকান্ত তখন সুপারস্টারের মঞ্চে উঠছেন; কিন্তু তখনও ভগবান হননি… 

১৯৯৫ সাল। ততদিনে বলিউডেও পা রাখা হয়ে গেছে রজনীকান্তের। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন। এমন সময়ই বের হল ‘বাশা’। মানিক বাশার চরিত্রে বছর পঁয়তাল্লিশের রজনীকান্তের ‘খেল’ দেখে চমকে গেল ভারত। পর্দা জুড়ে দৌরাত্ম্য করেছেন তিনি। এমন সব কাজ করেছেন, যা বাস্তবে হওয়া অসম্ভব। রজনীকান্তের জীবনে তো বটেই, ভারতের সিনেমার ইতিহাসেও ‘বাশা’ এক মাইলস্টোন। বলা ভালো, এরপরই ‘সুপারস্টার’ থেকে ‘থালাইভা’ হয়ে যাওয়া রজনীকান্তের। দক্ষিণী ছবির দর্শকদের কাছে তিনি তখন ভগবানের প্রতিরূপ। এরপর ২০০৭ সালের ‘শিবাজি’ সমস্ত রেকর্ড ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল। ১০০ কোটির ক্লাবে ঢোকা ভারতের প্রথম সিনেমার তকমা পেল এটি। আর রজনীকান্ত? একটা সময় দেখেছেন দারিদ্র্যের করাল রূপ; আর এই সিনেমার পরই এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত অভিনেতা হয়ে গেলেন তিনি। 

অবশ্য সিনেমার বাইরের থালাইভা একদম অন্য মানুষ। ভদ্র, মিতভাষী মধ্যবিত্ত ছেলেটি যেন এখনও রয়ে গেছে তাঁর মধ্যে। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনও সবার সামনে তুলে ধরেন। দেখেন ভক্তদের উন্মাদনা। থালাইভার সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে মানে অফিস আদালত ছুটি হয়ে যাওয়া। জন্মদিনে তাঁর ছবি নিয়ে এসে, মূর্তি তৈরি করে রীতিমতো পুজো করেন ভক্তরা। তিনি যে ‘গড অফ ইন্ডিয়ান সিনেমা’! এমনই তাঁর প্রভাব, রজনীকান্ত যে চরিত্রে অভিনয় করেন, তাঁকে অধিকাংশ সময়ই পর্দায় মরতে দেখা যায় না। ভগবান কি মারা যান? আর পরিচালকরাও জানেন, রজনীকান্ত পর্দায় মারা গেলে, পর্দার বাইরে বিক্ষোভ শুরু হবে… 

আরও পড়ুন
‘ওকে একবার অভিনয়ের সুযোগ দিন’, বন্ধুর জন্য গুরুর পা পর্যন্ত ধরেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী

এমন প্রভাব, এমন ফ্যানডম আর কেউ পেয়েছেন কি! পুরস্কারের ব্যাপার তো ছেড়েই দিন। রজনীকান্ত জীবন্ত একজন কিংবদন্তি। তাঁর অসুস্থতার খবর শুনে এক ভক্ত আত্মহত্যাও করতে যান; যাতে তাঁর মরদেহ থেকে কিডনি নিয়ে থালাইভার চিকিৎসায় ব্যবহার করা যায়। শেষ পর্যন্ত হাসপাতালের বেডে শুয়ে রজনীকান্তকে ছবি দিয়ে জানাতে হয় যে, তিনি ঠিক আছেন। এখনও দিব্যি আছেন। ভগবান এত সহজে মরে না। তাঁর নাম যে শিবাজি; তিনি রজনীকান্ত। 

তথ্যসূত্র-
১) ‘আজ ভারতের ‘সুপারম্যান’-এর জন্মদিন’, মাসুম আলী, প্রথম আলো
২) ‘অপ্রতিরোধ্য এক অভিনেতা রজনীকান্ত’, আলাউদ্দিন মাজিদ, বাংলাদেশ প্রতিদিন
৩) ‘রজনীকান্ত: বাস কনডাক্টর থেকে সুপারস্টার!’, অনামিকা রিপা, এগিয়ে চলো 

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
প্রমথেশ বড়ুয়াই প্রকৃত ‘দেবদাস’, অভিনয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন উত্তমকুমার

More From Author See More