স্যানিটারি প্যাডের পর, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকারের লড়াইয়ে শামিল কলকাতার ‘প্যাডম্যান’ শোভন

“একটা সময় যখন স্যানিটারি প্যাড নিয়ে কাজ শুরু করি, তখন নানা জনে নানা কথা বলত। ছেলে হয়ে কেন এসব নিয়ে কাজ করিস— ইত্যাদি। কিন্তু আমি কখনও এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। ভালো কাজ করতে গেলে লোকে কথা বলবেই। তাই বলে লড়াইয়ের ময়দানটা ছেড়ে দিলে তো চলবে না। আমার মা-বাবাও এমন শিক্ষাই দিয়েছেন আমায়। সেই জোরেই এখনও কাজ করে যাচ্ছি, ভবিষ্যতেও করে যাব। এই সমস্ত কথা তাতে কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না।”

প্রহরকে বলছিলেন শোভন মুখোপাধ্যায়। অবশ্য অনেকের কাছে তাঁর পরিচয় অন্য একটি নামে। তিনি কলকাতার ‘প্যাডম্যান’। শহরের বুকে স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছেন তিনি। মহিলাদের প্রতিটা সুলভ শৌচালয়ের বাইরে নিয়ম করে রেখে দিয়ে আসছেন স্যানিটারি প্যাড। কখনও নিজেই উদ্যোগ নিয়ে বসাচ্ছেন ভেন্ডিং মেশিন। ওপরের কথাগুলো যখন বলছিলেন, ভেতরে একটা অদ্ভুত তেজ বয়ে যাচ্ছিল। যার আঁচ খানিক এসে লাগে আমাদের গায়েও। এই সাহস এবং ভালো কাজ করার ইচ্ছাই শোভন মুখোপাধ্যায়ের চালচিত্র।

যাত্রাটা শুরু হয়েছিল অদ্ভুতভাবে। তখন স্নাতকোত্তরের পড়া চালিয়ে যাচ্ছেন শোভন। তারই ফাঁকে চলছে তাঁর সামাজিক কাজ। কয়েকজন বন্ধু মিলে বের করছেন একটি পত্রিকা— ‘কবিকলম’। শুধু কবিদেরই জায়গা নয়, নিজের পত্রিকায় সমাজের বিভিন্ন ঘটনা ও ইস্যু নিয়েও লিখতেন শোভন। সেই পত্রিকার জন্যই প্রতি মাসে বন্ধুরা এক জায়গায় জড়ো হতেন; শুরু হত মিটিং। ২০১৭-এর অক্টোবরে সেরকমই একটি মিটিংয়ের আয়োজন হয়েছিল। সবাই বসে আছে, হঠাৎই শোভনের কাছে তাঁরই এক বান্ধবীর ফোন এল। সে এই মিটিংয়েই আসছিল, কিন্তু রাস্তাতেই তার ঋতুস্রাবজনিত সমস্যা শুরু হয়। এদিকে প্যাড না থাকায় বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হয় তাকে। 

এরকম ঘটনা অনেকের সঙ্গেই হয়তো ঘটেছে। নিজের না হোক, বন্ধুদেরও দেখেছেন তাঁরা। কিন্তু কখনও এই আপাত ‘সামান্য’ ঘটনার গভীরের জটিল অবস্থাটাকে আমরা বুঝতে চেষ্টা করিনি। ভাগ্যিস, শোভন এই ‘গতানুগতিক’দের দলে পড়েন না! বান্ধবীর সঙ্গে ঘটা এমন ঘটনাই তাঁকে আরও ভাবাতে বাধ্য করল। এটা তো একজন বা দুজনের সমস্যা নয়, হাজার হাজার মানুষ এই সমস্যায় ভোগেন। রাস্তায় যদি স্যানিটারি প্যাডের বন্দোবস্ত থাকত, তাহলে কি এমনটা দেখতে হত? লোকজনদের জিজ্ঞেস করা শুরু করেন তিনি। এখান থেকেই আরম্ভ হয় এক বিরাট কর্মযজ্ঞের। কেমন হয়, যদি কলকাতার সমস্ত সুলভ শৌচালয়ে স্যানিটারি প্যাড পাওয়া যায়? এই প্রশ্ন থেকেই যাত্রা শুরু ‘বন্ধন’-এর। ২০১৭-এর ভাইফোঁটার আগে আগেই বাঁশদ্রোণীর সুলভে গিয়ে রেখে আসেন স্যানিটারি ন্যাপকিন। “একটা আইসক্রিমের বাক্সকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে সেখানে রেখে আসি; ভেতরে প্যাড। যার প্রয়োজন হবে সে এসে নিয়ে যাবে। প্রথমে বিনামূল্যেই রেখেছিলাম এই ব্যবস্থা। পরে দেখলাম, প্রয়োজনের বেশিও লোকে নিয়ে যাচ্ছে। আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত চেষ্টা থেকে এই উদ্যোগে আসা, ফলে আমারও একটা আর্থিক বাধ্যবাধকতা আছে। শেষে তিন টাকার বিনিময় একটা স্যানিটারি প্যাড নেওয়ার ব্যবস্থা চালু করি আমি”, বলছিলেন শোভন মুখোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন
ইংল্যান্ডে প্রথম প্রাইড ট্রেনের যাত্রা শুরু, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের ভিড়ে নতুন বার্তা

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সমাজের কাছে আজও ঋতুস্রাব একটা ট্যাবু। বাংলা তো বটেই, ভারতেরও অনেক জায়গায় এই একবিংশ শতকে এসেও মহিলারা স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করেন না। অনেক ক্ষেত্রে জোগান থাকে না; আবার সামাজিক কটূক্তিও সেখানে কাজ করে। এটি যে মেয়েদের একটা স্বাভাবিক শারীরিক ব্যাপার, সেটা মানতেই চান না অনেকে। এমনকি, অনেক জায়গায় মেয়েরা রীতিমতো ‘অস্পৃশ্য’ হয়ে যায় এই সময়। কাজেই সেই বিষয় নিয়ে যখন কাজ করতে যাচ্ছেন, উল্টো দিক থেকে ঝড় তো আসবেই। শোভনকে একসময় শুনতে হয়েছে নানা কটু কথা। ‘মেয়েদের ব্যাপার নিয়ে এত মাথা গলানো কেন?’— এটাই ছিল ‘সমাজের’ প্রাথমিক প্রশ্ন। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে তিনিই দেখেছেন, সমাজের নিচুতলার মানুষ বলে যাঁদেরকে সরিয়ে রাখি আমরা, তাঁরাই বেশি করে সাহায্য করেছেন। বরং বাধা এসেছে ওপরতলা থেকে। 

‘প্যাডম্যান’ সিনেমাটার সঙ্গে পরিচিত যারা, তাঁরা দেখেছেন এই সামাজিক যুদ্ধ। তবে সেই  যুদ্ধ পেরনোর সাহস আছে শোভনের। “এখনও অবধি কলকাতার ৭০টি সুলভ শৌচালয়ে স্যানিটারি প্যাড রাখতে পেরেছি আমি। কিন্তু আমার লক্ষ্য কলকাতার প্রতিটা জায়গাতে যাতে এই কাজটা ছড়িয়ে পড়ে। ‘প্যাডম্যান’ সিনেমাটা হওয়ার সময় স্বয়ং অভিনেতা অক্ষয় কুমার ফোনে কথা বলেছিলেন। বর্তমানে স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিনও বসানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিছু জায়গায় বসাতে পেরেছি। অভিনেত্রী ঋতাভরী চক্রবর্তী এবং রাহুল দাশগুপ্ত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। শুধু সরকারি অনুমতি পেতেই যা দেরি হচ্ছে। পৌরসভার পক্ষ থেকে অনুমতি পেয়ে গেলেই কাজ শুরু করে দেব।”

আরও পড়ুন
কলকাতার বাসে চালু হচ্ছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য সংরক্ষিত আসন

শুধু প্যাডেই থেমে নেই; আস্ত একটা অ্যাপও বানিয়ে নিয়েছেন শোভন। ওই অ্যাপের মাধ্যমে কোথায় কোথায় স্যানিটারি প্যাড মজুত রয়েছে তা সহজেই জানা যাবে। “সমস্ত মডেল তৈরি। শুধু একটু সহায়তা দরকার। তা নাহলে এই কাজটা পরিণতি পাবে না।” তবে এই একটা জায়গাতেই থেমে নেই শোভন মুখোপাধ্যায়ের পরিধি। সমাজের আরও একটা অবহেলিত শ্রেণীকে নিয়ে কাজে নেমেছেন তিনি। সুপ্রিম কোর্টের রায়, সচেতনতা, সিনেমা— সমস্ত কিছু থাকা সত্ত্বেও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা আজও বঞ্চিত। আজও সমাজের আড়চোখে তাকিয়ে থাকার সামনে বসে রয়েছেন তাঁরা। একদম শুরুতে তাঁদের জন্যই এগিয়ে এসেছিলেন শোভন। ‘ত্রিধারা’ প্রকল্পের যাত্রা এই করেই। ২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে শুরু করেছিলেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য সুলভ শৌচালয়ে পৃথক ঘরের ব্যবস্থা। সেই কাজটাই এগিয়ে যায় লকডাউনের সময়। শোভনের দাবি ছিল, বেসরকারি বাসে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য বসার জায়গা সংরক্ষণ করা। সেই চেষ্টা থেকেই দুটো রুটের বাসে এই উদ্যোগ করা গেছে। 

বাধা আসেনি? “আমার কাছে লিঙ্গ বলে কিছু নেই। সবার আগে মানুষ। সমাজের একটা অংশকে সম্পূর্ণভাবে একঘরে করে রাখা হল, এমন ব্যাপার কেন? এই মানুষগুলোকে নিয়ে যখনই কাজ করতে গিয়েছি আরও বেশি কটূক্তির মুখে পড়েছি। তবে আমি হার মানিনি। যখন বাসের ইউনিয়নে কথা বলতে গিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম ওদের বোঝাতে সময় লাগবে। শেষে দেখলাম, পাঁচ মিনিটের মধ্যে তাঁরা রাজি হয়ে গেলেন! অথচ তথাকথিত শিক্ষিত মানুষরাই হাসাহাসি করেছে এমন কাজ নিয়ে। আমি সংরক্ষণের সমর্থক নই; কিন্তু যেখানে পুরুষ আর মহিলাদের জন্য আলাদা আলাদা ঘর রয়েছে শৌচালয়ে, বাসে আলাদা বসার জায়গা রয়েছে, তাহলে ট্রান্সজেন্ডার মানুষগুলো কেন সুযোগ পাবেন না? তাঁদেরও তো বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তাঁরাও তো মানুষ।” 

আরও পড়ুন
পৃথিবীতে প্রথমবার, স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে স্বীকৃতি পেলেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরাও

দিনের শেষে সমস্ত ট্যাবু ভাঙবেই, এই বিশ্বাসই রাখেন শোভন মুখোপাধ্যায়। বহু পুরস্কার পেয়েছেন, পরিচিতি পেয়েছেন; সমস্ত কিছু কাজে লাগিয়েছেন কাজগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। “আমাকে পুরস্কার দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আমি শুধু চাই স্যানিটারি প্যাডের ভেন্ডিং মেশিনের কাজটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাক। আমি চাই এই সামাজিক বাধাগুলো ভেঙে যাক। আমাকে পুরস্কার দিয়ে কী হবে!” যে মানুষটা অকপটভাবে এই কথাগুলো বলতে পারেন, তিনি যে এত তাড়াতাড়ি থামবেন না তা বলাই বাহুল্য। 

থামেনওনি তিনি। লকডাউন, আমফানের মধ্যেও ছুটে বেরিয়েছেন সর্বত্র। এখন সুন্দরবনের মানুষদের জন্যও এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সেখানে গিয়ে থাকা, মানুষদের সাহায্য করা, খাবার দেওয়া তো আছেই; সেইসঙ্গে আছে স্যানিটারি প্যাডও। মেডিক্যাল ক্যাম্প করে সবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার বন্দোবস্ত নিয়েছেন। সঙ্গে তো আছেই ‘বন্ধন’ আর ‘ত্রিধারা’। সবকিছু নিয়ে বিজয়রথ এগিয়ে চলেছে শোভন মুখোপাধ্যায়ের। অচলায়তনের পাঁচিল একদিন ভাঙবেই, ভাঙবেই। “শুধু আফসোস হয়, স্যানিটারি প্যাড নিয়ে কলকাতায় প্রথম প্রচার শুরু করেছিলাম। আজ দিল্লি বা মুম্বইয়ের মতো জায়গা এই ব্যাপারে এগিয়ে গেছে। কলকাতা এগোতে পারল না তেমনভাবে।” যতদিন থাকবেন, কাজ করে যাবেন। হাজার ঝড় এলেও লড়াই করবেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের। “লিখে কি আর সবকিছু হয়! কিছু কাজ তো মাঠে নেমেও করতে হয়।” সেই পথের শেষটাই দেখতে চান শোভন মুখোপাধ্যায়। আর সেটাই হবে আসল উদযাপন… 

Powered by Froala Editor