ব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাসের বিচিত্র গল্প শুনিয়েছেন বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ

সূর্যে আঁচ দেওয়া কার কাজ? পৃথিবীর লেত্তিটা কি কখনও ঘুরিয়ে দেওয়া যায়? কাজেই আমি কীভাবে এই প্রশ্নগুলো করলাম, সেটা বড়ো কথা নয়। কিন্তু কোন ভাবনা থেকে প্রশ্নগুলো করলাম, সেটা একটা বিষয় হতে পারে। এখান থেকেই বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মবাদ মিশে যায়। ‘যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্ মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।’ যাঁরা যেভাবে তাঁরা ভজনা করে, তিনি সেই ভাবেই তুষ্ট হন। মানুষ তার সর্বভাবের মধ্য দিয়ে হয়তো তাঁর পথই অনুসরণ করছে। ‘তিনি’ এখানে ঈশ্বর হতে পারেন অথবা বিজ্ঞান। কিন্তু এই অনুসরণের ফলেই মহাবিশ্বের কাঠামোর নতুন আবিষ্কার সম্পর্কে মানুষের এত আগ্রহ, উত্তেজনা।

পদার্থবিদ, পরমাণু বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহের প্রয়াণের খবর শোনার পর থেকে কথাগুলি মনে হচ্ছে। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে ফ্রেড হয়েল, ডেনিস সিয়ামা, হারমান বন্ডি, জয়ন্ত নারলিকর এবং অন্যরা সবাই কেমব্রিজে মহাবিশ্বের কাঠামোর একটি আকর্ষণীয় এবং প্রায় নির্মল তত্ত্ব প্রস্তাব করেছিলেন— যাকে বলা হয় ‘স্থির অবস্থা তত্ত্ব’। এই তত্ত্ব অনুসারে মহাবিশ্ব অনন্ত। এটি এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে সর্বদা সম্প্রসারিত হচ্ছে মহাবিশ্ব। সেই চোদ্দশত কোটি বছর আগে বিস্ফোরণের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর সৃষ্টি হল, আর আধুনিক বিজ্ঞান তাকে ডাকল ‘বিগ ব্যাং’। সেখানে কখনও একটি ধ্রুবক গড় ঘনত্ব বজায় রাখছে। কোনো পদার্থ ক্রমাগত একই হারে নতুন নক্ষত্র এবং গ্যালাক্সি তৈরির জন্য তৈরি হচ্ছে। একটি স্থির-স্থিত মহাবিশ্বের সময়ের কোনো শুরু বা শেষ নেই। এর মধ্যে যেকোনো বিন্দু থেকে গ্র্যান্ড স্কেলের দৃষ্টিভঙ্গি, অর্থাৎ, গ্যালাক্সির গড় ঘনত্ব এবং বিন্যাস দুই-ই এক। ঠিক এই জায়গাতেই মহাবিশ্বের কোনো শুরু নেই, শেষ নেই। তা অনন্ত। বিকাশ সিংহের মতে, এভাবেই মহাবিশ্ব বিস্তৃত হচ্ছে।

আমরা এর আবিষ্কার থেকে কী অর্জন করতে পারি? একটি একক বিগ ব্যাং বা একাধিক স্মল ব্যাং কি মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছে? বিগ ব্যাং-এর আগে কী ছিল? আপাত নিরিখে এই সহজ, কিন্তু জটিল প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলে বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহের গবেষণায়। আসলে তিনি বিজ্ঞান-সাধক। তাঁর গবেষণায় যে নান্দনিক আবেদন ছিল, সেটাই তাঁকে ব্যতিক্রমী করে তুলেছে। পারমাণবিক পদার্থবিদ্যা এবং উচ্চ শক্তির পদার্থবিদ্যায় বিস্তর কাজ রয়েছে তাঁর। সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স এবং ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টারের পরিচালক এবং ২০০৫ সালের জুন মাসে দুর্গাপুরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির বোর্ড অফ গভর্নরসের চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি। কিন্তু মহাজাগতিক ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। ব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাসের বিচিত্র সব গল্প শুনিয়েছেন বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ। কিন্তু ব্রহ্মাণ্ড কখনও ধ্রুব ছিল না বা থাকবে না। আমার বার বার মনে হয়, ব্রহ্মাণ্ড ধ্রুবই। মানুষ পৌঁছতে পারে না বলেই তা ধ্রুব নয়। অনেকটা আঙুর ফল টকের মতো ব্যাপার। ব্রহ্মাণ্ড যদি জ্ঞান হয়, তা তো আপন সুরে বিশ্বলয়ে খেলছেই। আমরাই বরং তাকে খুঁজছি প্রতিনিয়ত, প্রতি মুহূর্তে, কখনও তত্ত্ব দিয়ে, কখনও নিজের মতো। বিজ্ঞান থেকে বিজ্ঞানী, সাধক থেকে সাধনা মিশে যেতে পারে এখানে। তিনি বিশ্বাস করতেন— রেনেসাঁ থেকে জ্ঞানদীপ্তি, শিল্প বিপ্লবে উদ্ভাসিত পশ্চিমা চিন্তাধারা, আইজ্যাক নিউটনের আবিষ্কারের পর থেকে আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতি গভীর, নিবিড়, বিস্তৃত, বিচিত্র, বহুমুখী এবং সৃজনশীল। টেলিগ্রাফকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন, রেনে দেকার্তের কার্টেসিয়ান যুক্তিই হোক কিংবা ইমানুয়েল কান্টের আকর্ষক মানবতাবাদ, হেগেলের দ্বান্দ্বিক মতবাদ হোক কিংবা কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের অর্থনৈতিক দর্শন অথবা সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সূক্ষ্মতম মনস্তাত্ত্বিক অন্বেষণ— এই সবই বুদ্ধিবৃত্তিক-সৃজনশীল প্রক্রিয়া। এগুলি জ্ঞান ও উপলব্ধির সীমানাকে প্রশস্ত করেছে। যে ভগ্নাবশেষ থেকে নতুনের সৃষ্টি, নয়া যুগের সৃষ্টি— সেই নতুনেই যেন মিশে যাচ্ছেন বিকাশ সিংহ, কোনো এক ব্রহ্মাণ্ড-মুহূর্তে। মৃত্যু পথযাত্রীদের দলে নয়, বরং বিকাশ সিংহের গবেষণা ব্রহ্মাণ্ডের পথযাত্রী হয়ে ভবিষ্যতেও হয়তো নানান পরত খুলবে। এভাবেই হয়তো বিজ্ঞান আম-মানুষের দরবারে তখন পৌঁছে যাবে।

Powered by Froala Editor