অরণ্যঘেরা ‘ক্ষুদিরাম গুহা’ ও অগ্নিযুগের অনালোচিত ইতিহাস

তখন এপ্রিল। বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত এই গ্রাম উঠে এসেছিল খবরের শিরোনামে। চারদিকে জঙ্গল-ঘেরা ছেঁদাপাথর গ্রামে রেল টেকা এবং ডহর ছেঁকা নিয়ে আদিবাসী কুড়মি সমাজের সাংগঠনিক বৈঠক হয়েছিল। যদিও মাঝেমধ্যেই ভিন্ন কারণে শিরোনামে উঠে আসে এই গ্রাম।

প্রত্যন্ত এই গ্রামে রয়েছে গাছগাছালি ঘেরা একটি চুনাপাথরের গুহা। গ্রামবাসীরা গুহাটিতে ডাকেন ‘ক্ষুদিরাম গুহা’ (Khudiram Guha)। ইতিহাসের ছোঁয়া রয়েছে এই গুহার মজ্জায়, পাথরে। বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ছেঁদাপাথরের এই গুহায় নিতেন অস্ত্রশিক্ষা। শিখতেন গুলি ও বোমা ছোড়া। অবিভক্ত বাংলায় বিশ শতকের শুরুর দিকে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। ওই সময় গোপনে গঠিত হয় বিভিন্ন গুপ্ত সমিতি। তবে, সমিতি গড়ে উঠলেই তো হবে না। ইংরেজদের সঙ্গে সমানে পাঙ্গা নিতে গেলে দরকার প্রয়োজনীয় অস্ত্র প্রশিক্ষণ। সেই অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য দরকার পড়ে গুপ্ত জায়গা। বাঁকুড়ার গভীর জঙ্গলের মধ্যে তেমনই এক জায়গা ছিল ছেঁদাপাথর। বারিকুল থানার অদূরে এই গ্রাম। অন্যদিকে, গ্রামটি থেকে ঝাড়গ্রামও খুব বিশেষ দূরে নয়। দেখতে গেলে, বাঁকুড়া থেকে গ্রামটির দূরত্ব ঝাড়গ্রামের চেয়ে বেশি। যদিও কিলোমিটার মাপা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। 

বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য ছেঁদাপাথরকেই কেন বেছে নিয়েছিলেন? জানা যায়, জমিদার ধবলদেও-র পরিবারের সঙ্গে বিশেষ পরিচিত ছিলেন ক্ষুদিরাম। প্রসঙ্গত, এই ধবলদেও-র অধীনেই ছিল এই অঞ্চল। যাই হোক, লর্ড কার্জনের ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা গোটা দেশের সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে দিয়েছিল। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন বাংলায় তখন মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সে-সময় বহু বিপ্লবী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। তাদের মধ্যে মেদিনীপুর অনুশীলন সমিতি উল্লেখযোগ্য। 

ছেঁদাপাথর গ্রামের গোপন এই বিপ্লবী ঘাঁটি বিপ্লবীদের মিলনস্থল ছিল। একদিকে এলাকাটি জঙ্গলে ঘেরা। তাই ব্রিটিশ পুলিশের শকুনে দৃষ্টি এড়ানো যেত সহজেই। জমিদার নরেন গোঁসাই এই জায়গাটির সন্ধান দিয়েছিলেন বিপ্লবীদের। 

যে বয়সে ছেলেরা বই আর স্কুলজীবনে মগ্ন থাকে, সেই বয়সে ক্ষুদিরাম বসু নেমে পড়েন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। এই গ্রামেই তিনি প্রশিক্ষণ নেন। পরে তাঁকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রচারপত্র বিলি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ১৯০৬ সাল। বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসু ‘বন্দে মাতরম্’ লিখে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রচারপত্র বিতরণের দায়িত্ব দেন তাঁকে। মেদিনীপুরে আয়োজিত এক মেলায় এই প্রচারপত্র বিলি করার পরিকল্পনা ছিল। ব্রিটিশরা বিষয়টি জানতে পারে। ক্ষুদিরাম বসুকে দেখে ধরার চেষ্টা করা হয় তাঁকে। ব্রিটিশ অফিসারের মুখে ঘুঁষি মারেন ক্ষুদিরাম। তবে ব্রিটিশ সৈনিক হওয়ায় গ্রেফতার করা হয় ক্ষুদিরামকে। দেশের জন্য প্রথমবার গ্রেফতার হন তিনি। তখন ডগলাস কিংসফোর্ড ছিলেন জেলা জজ। এই বিচারকের ভারতীয়দের প্রতি তীব্র ঘৃণা ছিল। শাস্তির নামে ভারতীয়দের বেত্রাঘাত করা হত। ১৫ বছর বয়সি ক্ষুদিরামকে বিচারক ১৫টি বেত্রাঘাতের সাজা দেন। বিচারক কিংসফোর্ড ভারতীয়দের কাছে একপ্রকার ‘ত্রাস’ ছিলেন। পরে এই জজ সাহেবকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।

যাই হোক, পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার রানিবাঁধের কাছে ছেঁদাপাথরের অরণ্যাঞ্চলে বারীন্দ্রনাথ ঘোষ ও নরেন গোঁসাইরা এই গুপ্ত ঘাঁটি গড়ে তুলেছিলেন। নরেন গোঁসাই পরবর্তীতে বিপ্লবী বিভূতিভূষণ সরকারকে যুগান্তর দলে যোগ দেওয়ান। এই নরেন গোঁসাই-ই পরবর্তীতে মানিকতলা বোমা মামলায় রাজসাক্ষী হন। কিংসফোর্ড হত্যার প্রচেষ্টায় ক্ষুদিরাম ধরা পড়ার পর যখন কলকাতার পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট বাঁকুড়া জেলা সফরে ছিলেন, তখন বিভূতিভূষণকে গ্রেফতার করে কলকাতায় আনা হয়। তাঁকে নারায়ণগড়, মানিকতলা এবং দেওঘর বোমা মামলার একাধিক অভিযোগে বিচার করা হয়। আদালত তাঁকে আন্দামানে দশ বছরের দ্বীপান্তরে সশ্রম কারাদণ্ড দেয়।

স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামের এই গুহা পর্যটকদের কাছে দর্শনীয় জায়গা ছিল। কিন্তু সময় পরিবর্তন হয়েছে। গোটা জঙ্গলমহলে এককালে বেড়েছিল মাওবাদী উপদ্রব। শোনা যায়, ঐতিহাসিক এই গুহাটিতে মাওবাদীরা ব্যবহার করতে পারে এমন আশঙ্কায় গুহার প্রবেশের মুখ প্রশাসন থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদিও পড়ে খোলা হয়েছিল মুখ। জায়গাটিকে সংগ্রহশালা হিসেবে গড়ে তুললে বাঁকুড়ার পর্যটন মানচিত্রে আরও একটি পালক যে যুক্ত হবেই তা বলাই বাহুল্য। অন্যদিকে, দু’মাস প্রহসন শেষে ক্ষুদিরামকে মৃত্যুদণ্ডের রায় শোনানো হয়। ক্ষুদিরাম তখনো হাসছিলেন। ক্ষুদিরামের আত্মপক্ষ সমর্থনের মামলা গ্রহণ করা বিচারক কালিদাস বসু বাধ্য হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘এর মানে কি বুঝতে পারছ?’ দ্রুত উত্তর আসে, ‘আপনার চেয়ে ভালো।’ বিচারক আবার বলেন, ‘তোমার কি কিছু বলার আছে?’ জবাব, ‘হ্যাঁ। আমি বোমা বানানোর বিষয়ে কিছু কথা বলতে চাই।’ ক্ষুদিরামকে শেষ জবানবন্দি দিতে বাধা দিতে হয়েছিল বিচারককে। কালিদাস বসু কলকাতা হাইকোর্টে আপিল পর্যন্ত করেছিল। যদিও তাতে লাভের লাভ কিছু হয়নি। ক্ষুদিরাম হয়তো বীর রাজপুত নারীদের মতো দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে চেয়েছিলেন। ফাঁসির চিন্তা তাই এতটুকুও অসুখী করেনি তাঁকে। যদিও কিংসফোর্ড তাঁর অপরাধের জন্য শাস্তি পাননি বলে একটা আপশোস হয়তো ছিল। তিনি হয়তো বলেছিলেন, ‘আমি শীঘ্র মরতে চাই যাতে আমি আবার ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই করতে ফিরে আসতে পারি।’ আজকের দিনে, ১১ আগস্ট, ১৯০৮ সালে ফাঁসির মঞ্চে শহিদ হন ক্ষুদিরাম। 

তথ্যসূত্র :
১. ছেঁদাপাথরে এখনও রয়েছে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের গোপন সুড়ঙ্গ, মনে জাগায় বিস্ময়, আনন্দবাজার পত্রিকা।
২. ‘আদালত তাঁকে আন্দামানে দশ বছরের দ্বীপান্তরে সশ্রম কারাদণ্ড দেয়।’— সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা।
৩. স্বাধীনতা সংগ্রামী চরিতাভিধান - ডাঃ ননীগোপাল দেবদাস

Powered by Froala Editor