বিদ্যাসাগরের জন্মদিনেই পালিত হোক শিক্ষক দিবস, আবেদন নেটিজেনদের

কলা, বাণিজ্য কিংবা বিজ্ঞান— এসব তো অনেক পরের প্রশ্ন। প্রাথমিকভাবে শিক্ষার বুনিয়াদ গড়তে যার প্রয়োজন আবশ্যিক হয়ে পড়ে, তা হল ভাষা। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে মাতৃভাষা। আর ভাষাকে আয়ত্তে আনার এই পথটাই শুরু হয় বর্ণকে চিনতে শেখার মধ্য দিয়ে। আজও সশরীরে উপস্থিত না থেকেও সেই শিক্ষার শিলান্যাস করেন যিনি হাতে ধরে, তিনি আর কেউ নন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাংলার এই প্রাণপুরুষের জন্মদিন পালিত হোক জাতীয় শিক্ষক দিবস উপলক্ষে, এমনই দাবি জানালেন নেটিজেনদের একাংশ। বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবর্ষের প্রাক্কালে বাংলা ভাষার অন্যতম পথিকৃৎকে শ্রাদ্ধাজ্ঞাপনের অভিনব পথ দেখালেন তাঁরা।

এই প্রসঙ্গেই প্রহর কথা বলেছিল রামকৃষ্ণ সারদামিশন বিবেকানন্দ বিদ্যাভবন কলেজের শিক্ষাবিজ্ঞানের অধ্যাপিকা রোহিণী ধর্মপালের সঙ্গে। তিনি জানান, “বিদ্যাসাগরের জন্মদিন শুধু বাঙালি বলে না, সারা দেশের মানুষেরই পালন করা উচিত। সংস্কৃত, বাংলা এই দুই ভাষা; মেয়েদের শিক্ষা এবং শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে ওনার অবদান অস্বীকার করা অসম্ভব। এবং বিভিন্নক্ষেত্রে একজন সমাজকর্মী হিসাবেও। মানে বিধবা বিবাহ তো শুধু বাঙালির বিধবাদের জন্য নয়, বরং সারা দেশের বিধবাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ফলত কেউ যদি বলে বিদ্যাসাগর তো বাঙালি আইকন। সেটা মোটেও ঠিক নয়। সুতরাং বিদ্যাসাগরের জন্মদিন শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করা দরকার, সেটাই মনে হয়েছে আমাদের...।”

সত্যিই তো শুধুই কি ‘বর্ণ’-এর সঙ্গে ‘পরিচয়’ করাতে, প্রথম বাংলা লিপি সংস্কারেই ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি? বাংলা ভাষাকে যেমন যুক্তিগ্রাহ্য এবং সকলের বোধগম্য করে তুলেছিলেন বিদ্যাসাগর, তেমনই হিন্দি ভাষার সাহিত্যকেও বাংলায় অনুবাদ করে পাঠের সু্যোগও করে দিয়েছিলেন তিনি। মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা এবং প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম তৈরির কাজও তাঁর হাত ধরেই। এছাড়াও উনিশ শতকের রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থার সময়ে দাঁড়িয়ে নারী শিক্ষার প্রচলন করেছিলেন বিদ্যাসাগর। গড়ে তুলেছিলেন অন্তত ৪০টি নারী বিদ্যালয়।  

তবে প্রথাগত এই শিক্ষার বিষয় থেকে সরে এসে তাঁর সামাজিক কাজের দিকগুলোয় দেখলেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তাও একপ্রকার পাঠক্রমই। বিধবা বিবাহ প্রণয়ন কিংবা বাল্যবিবাহ বন্ধ করার উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজের অন্ধকার দিকগুলোকে আলোর দিশাই তো দেখাতে চেয়েছিলেন তিনি। এমনকি নিজে দায়িত্বও তুলে নিয়েছিলেন বহু নারীর বিধবা বিবাহের। ঘটিয়েছিলেন বাল্যবিবাহের অবসানও। নারী-অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করতে প্রায় দেড় শতাব্দী আগেই সরব হওয়ার শিক্ষাও তো তাঁর কাছ থেকেই। যা আজকের দিনে দাঁড়িয়েও ভীষণ ভাবেই প্রাসঙ্গিক।

আরও পড়ুন
নিমতলা শ্মশানে তোলা হয়েছিল বিদ্যাসাগরের মরদেহের ছবি, ১২৯ বছর পর সেখানেই বসছে ফলক

এই প্রসঙ্গেই রোহিণী ধর্মপাল উল্লেখ করেন, “বিধবাবিবাহ সেই সময়ে যে কটা হত, আজও হয়তো সেই কটাই হয়। ফলে বিদ্যাসাগরের সেই গুরুত্ব তো রয়েই গেছে। আমরা মেয়েদের বিকাশের কথা এখনও বাহ্যিক। এখনও সমান অন্ধকার, সেই জাতিভেদ, বর্ণভেদ, পিছিয়ে থাকা। শুধুমাত্র সংবাদপত্রের পাত্র-পাত্রী চাইয়ের পাতাটা দেখলেই বিদ্যাসাগরের প্রাসঙ্গিকতা কতটা সেটা বোঝা যায়। আর মাতৃভাষার ক্ষেত্রে যদি বলে সেই নিজস্বতা, স্বাতন্ত্র তৈরি করার উদ্যোগ, শিক্ষাক্ষেত্রে কোথায় এখনও?” 

বিদ্যাসাগর যে শিক্ষার প্রদীপটা জ্বালিয়ে গিয়েছিলেন, যে লড়াইয়ের বীজ বুনে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন মানুষের মননে, সেই লড়াই যে যোগ্য উত্তরসূরি খুঁজে পায়নি - তা বলাই বাহুল্য। ফলে আজকে পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এই মহামানব যেন গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেন আবার, তার জন্যই নেটিজেনদের এই উদ্যোগ। 

আরও পড়ুন
‘নতুন মাস্টার পড়াতে পারেন না’, শুনে বিবেকানন্দ-কে চাকরি থেকে বরখাস্ত বিদ্যাসাগরের

এতদিন ভারতে জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসাবে পালিত হয়ে এসেছে সর্বোপল্লী রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিনই। তবে সেই বিষয়ে বিতর্ক রয়েই গেছে অনেক। সেইভাবে লিখিত উল্লেখ না থাকলেও, বারবার আলোচনায় উঠে এসেছে রাধাকৃষ্ণণ নিজেই ছাত্রদের উপদেশ দিয়েছিলেন শিক্ষক দিবস পালনের। সেইসঙ্গে তাঁর নামে উঠেছিল ‘প্লেগিয়ারিজম’-এর অভিযোগও। থিসিস অনুকরণের সেই বিতর্কের জল গড়িয়েছিল আদালত পর্যন্তও। এইসব বিতর্ক থেকেই সরে এসে মানবতাবাদের মূর্তচরিত্র বিদ্যাসাগরের জন্মদিনই হয়ে উঠুক সকলের জন্য শিক্ষক দিবস, এমনটাই চাইছেন নেটিজেনদের একাংশ। এমনকি জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসাবে বিদ্যাসাগরের জন্মদিনকে পালন করার আবেদন রেখে মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতরেও চিঠি পাঠিয়েছে একটি বাংলা সংগঠন...

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
শুধু বিধবাদেরই নয়, পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে অনেককেই মাসিক ভাতা দিতেন বিদ্যাসাগর

More From Author See More

Latest News See More