১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই। বিদ্যাসাগরের শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না তার ক’দিন আগে থেকেই। রোগে ভুগে ভেঙে আসছিল দেহ। তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল কাছের মানুষজনের বিদায় সংবাদ। মানসিকভাবেও যথেষ্ট পীড়িত ছিলেন তিনি। শহরের যান্ত্রিক গতিময়তা আর ভালো লাগছিল না। মাঝেমাঝেই হাওয়াবদলের জন্যে ঘুরে আসছিলেন এদিক-সেদিক। তবু, কিছুতেই পেরে উঠছিলেন না আর। সমস্ত কাজ থেকে বিরতি নিতে বাধ্য হচ্ছিলেন। শুভাকাঙ্খীরা এসে দেখে যেতেন নিয়মিত। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এলেন একদিন। সুরেন্দ্র বাবুর পক্ককেশ দেখে বিদ্যাসাগর মৃদু হেসে ঠাট্টা করলেন। তবু, কোথাও কোনোখানে গোলমাল হচ্ছিল। বুঝছিলেন সবাই। অবশেষে ২৯ জুলাই রাত ১২টা পার করে সত্তর বছর বয়েসে দেহ রাখলেন তিনি। সময়টা তখন ২টো ১৮।
তারিখটা হওয়া উচিত ছিল ৩০ জুলাই। তবু, ২৯ জুলাইকেই বিদ্যাসাগরের মৃত্যুদিন হিসেবে ধরা হয়। সেই হিসেবে দেখতে গেলে আজ তাঁর ১২৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। বিদ্যাসাগরকে দাহ করা হয় নিমতলা শ্মশানঘাটে। ৩০ জুলাই এই জায়গাটিতেই উন্মোচিত হবে তাঁর স্মৃতিফলক। কেমন ছিল বিদ্যাসাগরের শেষ যাত্রার সেই দিন?
বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে যেটুকু জানা যায়, মারা যাওয়ার পর বিদ্যাসাগরের দেহটিকে শোয়ানো হয়েছিল তাঁর নিজের ব্যবহৃত পালঙ্কে। তারপর ভোর-ভোর তাঁর একমাত্র পুত্র নারায়ণ এবং অন্যান্য আত্মীয়বর্গরা মৃতদেহ বয়ে নিয়ে রওনা দেন নিমতলা শ্মশানের দিকে। পথে বিদ্যাসাগরের অতিপ্রিয় মেট্রোপলিটন কলেজের সামনে থামা হয় একটু। তারপর সোজা শ্মশান। চন্দন কাঠের চিতায় শোয়ানোর আগে স্নান করিয়ে একটা ফোটোগ্রাফ নেওয়া হয় মৃতদেহের। ছবিটি তুলেছিলেন শরৎচন্দ্র সেন। জীর্ণ দেহ, শীর্ণ মুখ। মৃত্যুর পর সেই মুখে তখন শান্ত, কমনীয়তার ছাপ।
বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর সময়ের আরেকটি তথ্য থেকে জানা যায়, তাঁর দেহ সৎকারের সময় নিমতলা শ্মশানে অন্য কোন দেহ উপস্থিত ছিল না। ফলত তাঁর দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হবার সময়টি ছিল বড়োই নির্বিঘ্ন। বড়োই নিজস্ব। সমস্ত জীবনের নানান উৎপীড়ন এবং নির্যাতনের মধ্যে দাঁড়িয়ে এই মুহূর্তটি যেন সত্যিই অর্জন করেছিলেন তিনি। পরদিন সংবাদপত্রে বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর খবরটি ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে সমগ্র বাংলা তথা ভারত। বিভিন্ন জায়গায় আয়জিত হতে থাকে সভা-সমিতি। সেসময়ের আরেকটি তথ্য থেকে জানা যায়, কলকাতায় বিরাট সভায় বহুলোক অশ্রুজলে বিদ্যাসাগরকে বিদায় জানালেও সংগৃহীত হয়েছিল মাত্র হাজার দশেক টাকা! যে বিদ্যাসাগরের গোটা জীবন কেটে গিয়েছে দান-ধ্যানে, তাঁর প্রয়াণসভায় সাকুল্যে উঠেছিল এই পরিমাণ টাকাই!
নিমতলা শ্মশানঘাটের যে জায়গাটিতে বিদ্যাসাগরের স্মৃতিফলকটি উন্মোচিত হবে ৩০ জুলাই, তার পিছনে রয়েছে কলকাতা পুরসভার সহযোগিতা। উল্লেখ্য নিমতলা শ্মশানে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের স্মৃতিফলক। এবার তার সঙ্গে যোগ হবেন বিদ্যাসাগরও। জানা গিয়েছে, এই ফলকটির স্থান হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ফলকটির ঠিক উল্টোদিকেই। মূলত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত ভারতসভা বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগই রয়েছে এর পিছনে। বহু আগে থেকে স্মৃতিফলকটি বসানোর কথা শুরু হলেও জায়গা নিয়ে সমস্যর সমাধানে কলকাতা পুরসভা উদ্যোগী হওয়ায় শেষমেষ ১২৯ বছর পর সম্ভব হলো এই কাজ!
বাঙালি তথা ভারতীয় নব্জাগরণের অন্যতম পুরোধা বিদ্যসাগরের মৃত্যুবার্ষিকীতে এহেন সম্মানজ্ঞাপনে কলকাতার ঋণ এবার কিছুটা লাঘব হল বলেই মনে করছে বাংলার শিক্ষাবিদ মহল।
আরও পড়ুন
‘নতুন মাস্টার পড়াতে পারেন না’, শুনে বিবেকানন্দ-কে চাকরি থেকে বরখাস্ত বিদ্যাসাগরের
তথ্যঋণ :
১) বিদ্যাসাগর চরিত— শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন
২) বিদ্যাসাগর— চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
আরও পড়ুন
শুধু বিধবাদেরই নয়, পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে অনেককেই মাসিক ভাতা দিতেন বিদ্যাসাগর
৩) বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ— ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
৪) কৌশিক মজুমদার
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
১৬৫ বছর আগেও আজকের বিদ্যাসাগর কলেজের সামনেই আক্রান্ত হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর