রামমোহনের ছবি ফেলে দিতে বলেছিলেন অভিমানী বিদ্যাসাগর

মাইকেল তাঁর সম্বন্ধে বলেছিলেন, "The genius and wisdom of an ancient sage, the energy of an Englishman and the heart of a Bengali mother".

মধুসূদন অর্থকষ্টে পড়েছেন, তাঁর শৌখিন জীবনযাপনের জন্য। বিদ্যাসাগর খবর পেয়েই টাকা পাঠিয়েছেন। তাও ধার করে। এই ঘটনা নিয়ে এক ব্যক্তি, তাঁর কাছে মাইকেলকে ম্লেচ্ছটেচ্ছ বলে অনুযোগ জানাল। সবটা শুনে হেসে ফেললেন ঈশ্বরচন্দ্র। তারপর মৃদুকণ্ঠে বললেন, 'তুমিও একটা মেঘনাদবধ কাব্য লিখে দেখাও…'।

আরও পড়ুন
চাকরির দায়ে হিন্দি শিখতে হয়েছিল খোদ বিদ্যাসাগরকেও

১৮৮০ সালের ১ই জানুয়ারি, বড়লাট তাঁকে সি-আই-ই উপাধি দিচ্ছেন। খবর রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছে চারপাশে। অথচ 'ঈশ্বরে'র খোঁজ মিলছে না। উপাধি নিতে গেলে চোগাচাপকান শামলা এঁটে রাজভবন যেতে হবে। এটা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। আর কে উপাধি দিচ্ছে তাতে বিদ্যাসাগরের কী যায় আসে? তিনি বসে রয়েছেন কার্মাটাড়ে। ঝুটঝামেলা মেটার পর ফিরবেন। ফিরলেনও। কিন্ত সরকার 'পদক' আর সার্টিফিকেট পাঠিয়েছে বাড়িতে। তা নিয়ে এক চাপরাশি দরজায় ঠায় দাঁড়িয়ে। ভেবেছে, বড়লোকের বাড়িতে মোটা বকশিশ মিলবে । কিন্ত এই 'বিটলে বামুন' তো সহজ লোক না! খানিকক্ষণ চাপারাশির মুখের দিকে তাকিয়ে স্বর্ণপদকটা গুঁজে দিয়েছেন হাতে। বললেন, 'এক কাজ করো , বাজারে গিয়ে বিক্রি করে ফেলো এটা। দুজনেরই লাভ তাতে!' চাপরাশি হতভম্ব।

ক্ষুদিরাম বসু কমলালেবু ছাড়িয়ে ফেলতে যেতেই, হাত চেপে ধরেছেন বিদ্যাসাগর। 'ফেলো না! যাদের খাবার, তারা খাবে।' জানলার পাড়ে ছড়িয়ে দিলেন খোসা। মুহূর্তে নেমে এলো কাকেরা। ঠোঁটে তুলে নিল মধ্যাহ্নভোজ।

উপাধিটি সংস্কৃতে, অথচ ইংরেজিয়ানার আকর ছিল জীবনযাত্রায়। বিভিন্ন চিঠি কিংবা দরখাস্ত পড়লে মনেই হবে না, লিখছেন কোনো এক বাঙালি। ১৮৯১ সালের 'হিন্দু নেশন' জানাচ্ছে, যে তাঁর লাইব্রেরি ভর্তি ছিল ইংরাজি বই। ঘরে পিতামাতার সুদৃশ্য অয়েল পেইন্টিং ঝুলত, যা কোনো ব্রিটিশ চিত্রকরের আঁকা… এমনকি নিজের হাতে বাগান করেছিলেন বিলিতি কায়দায়…

ইংরেজদের থেকে নিয়েছিলেন সময়ানুবর্তিতা। সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল তখন তিনি। অধ্যাপকরা কিছুতেই সময়ে ক্লাস করাতে ঢোকেন না। ছাত্রদের তাও ধমক ধামক দিয়ে সিধে করানো যায় । কিন্ত পিতৃসম শিক্ষকদের কী বলবেন? উপায় বেরোল শেষে। বিদ্যাসাগর প্রতিদিন দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন ঘড়ি ধরে। দেরি করে কোনো অধ্যাপক ঢুকলেই তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে বলেন, 'এই এলেন নাকি?' দু চারদিনের মাথায় কাজ হল। সময়ে ক্লাস আরম্ভ হতে লাগল সংস্কৃত কলেজে।

বিধবাবিবাহ আইন নিয়ে শোরগোল পড়ে গেল রক্ষণশীল সমাজে। বড়ো বড়ো বাবুরা বিবাহের বিরুদ্ধে গণস্বাক্ষরের আয়োজন শুরু করলেন। ঈশ্বর গুপ্ত, তাঁর বিরুদ্ধে 'সংবাদ প্রভাকরে' লিখে ফেললেন ছড়া। কিন্ত লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ছিল 'মেয়েলি' গান।

'…কি লিখন লিখেছে বিধি কপালে, সিন্দুর পরিতে বুঝি হলো এবার কপালে, একাদশী করা বুঝি উঠালে, ডায়মোনকাটা মল বুঝি পরালে। বুঝি বিদ্যাসাগর এতদিনে, বিধবা নারীগণে, একলা শোয়ার কত জ্বালা জেনেছে, দিদি বিধি ভালো বিবেচনা করেছে।'

তবে গোঁড়াদের আক্রমণে পিছিয়ে গিয়েছেন অনেকে। তাঁর মধ্যে ছিলেন রাজা রামমোহনের পুত্র রমাপ্রসাদ। শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের বিবাহানুষ্ঠানে লোকনিন্দার ভয়ে উপস্থিত হতে পারেননি। খবর পেয়ে অভিমানে-রাগে স্তব্ধ হয়ে যান 'ঈশ্বর'। দেওয়ালে ঝুলছিল বীর রামমোহনের ছবি… সেদিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে সখেদে বলেছিলেন 'ওটা ফেলে দাও, ফেলে দাও!'

ছোঁয়াছুঁয়ি মানতেন না তিনি। বর্ধমানের মুসলমান পাড়ায় মহামারী ধরা পড়ে। ছুটলেন হোমিওপ্যাথির বাক্স নিয়ে। নিজের কোলে বসিয়ে চিকিৎসা করলেন রোগীদের…

এহেন ব্যক্তি তো রাজনীতিতে দাঁড়াতেই পারতেন । দাঁড়াননি। দাদাভাই নৌরোজিরা চিঠি পাঠিয়েছেন জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার জন্য। বিদ্যাসাগর সটান না করে দিলেন। তাঁর জীবনদর্শন আলাদা। মনে হয়েছিল, দেশের মানুষের দুর্দশা দূর করতে পারে একমাত্র নিরলস কর্মযোগ। চোঙা ফুঁকে তেমন লাভ নেই !

ঈশ্বরচন্দ্র , 'দেবতা' ছিলেন না। দোষেগুণে মানুষ। ইংরেজ প্রভুদের থেকে সহায়তা নেওয়াকে ভালো চোখে দেখেননি অনেকেই। কিন্ত তাঁর বিরুদ্ধে অনুচরবৃত্তির অভিযোগ কম মানুষই আনবেন । শিরদাঁড়াকে বিকিয়ে দেননি কখনও। পরিস্থিতি পছন্দ না হলেই, ইংরেজদের আচার ব্যবহারে খামতি থাকলেই পাঠিয়েছেন পদত্যাগপত্র। তা নিয়ে গোটা বাংলায় ছড়িয়ে আছে অসংখ্য মিথ।

বর্তমানে, রাজনৈতিক মহলে উনি 'সহজপাঠের লেখক' বলে খ্যাত। দূরদর্শী বিদ্যাসাগর কি বাঙালির এই আত্মবিস্মৃতি দেখেই শেষবয়সে চলে গিয়েছিলেন কার্মাটাড়ে? ঈশ্বর জানেন!

(প্রচ্ছদের ছবি - Pierre Sonnerat)