ফ্রান্সে তাঁর নামে ডাকটিকিট, গ্ল্যামারের উল্টোপিঠেই নন্দিতা চেনাচ্ছেন 'ডার্ক ইজ বিউটিফুল'

এই বছরেরই ঘটনা। করোনা পরিস্থিতি ও লকডাউনের জেরে ধুঁকছে গোটা দেশ। তারই মধ্যে আমেরিকায় আবারও হত্যা করা হল এক কৃষ্ণাঙ্গকে। কালো মানুষদের অধিকার, তাঁদের সম্মানের দাবি জানিয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন পৃথিবীর কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়ল। সেই আঁচ এসে পড়ল এই ভারতেও। আঙুল উঠল বাজারের তথাকথিত ‘ফেয়ারনেস’ ক্রিমগুলোর দিকে। একটি বহুজাতিক সংস্থার বিশেষ একটি প্রোডাক্টকে নিশানা করা হল। কিছু কিছু মহল থেকে আওয়াজ উঠল- এতটা করাও কি উচিত? আর ঠিক সেই সময়ই গর্জে উঠলেন নন্দিতা দাস। কেন উচিত নয়? যেভাবে বিপণনের মাধ্যমে বর্ণবৈষম্যের ধারা বজায় রাখা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে তো প্রতিবাদ করাই উচিত!

নন্দিতা দাস - এই নামটির সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। একাধারে অভিনেত্রী, পরিচালকও বটে। দুবছর আগে তাঁরই পরিচালনায় মুক্তি পেয়েছিল ‘মান্টো’। দর্শক থেকে সমালোচক— প্রত্যেকের ঘরে আবারও ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর নাম। অবশ্য এটা খুব নতুন নয় তাঁর কাছে। তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবিতে নন্দিতাকে সেরকমভাবে দেখা যায় না। তাঁর গোটা যাত্রাপথ জুড়েই রয়েছে ভারতের ইতিহাস, সমাজ ও যন্ত্রণা। আর রয়েছে মানুষ। যাদের শব্দগুলোই একটু একটু করে খোঁজার চেষ্টা করেন তিনি। 

নাম শুনলে অনেকেই মনে করেন, তিনি বাংলার। কিন্তু বহু সাক্ষাৎকারে নন্দিতা জানিয়েছেন, ‘দাস’ হলেও তিনি পশ্চিমবঙ্গের নন। বাবা ছিলেন ওড়িশার বিখ্যাত চিত্রশিল্পী যতীন দাস। মা ছিলেন লেখক। ছোটো থেকেই এমন পরিমণ্ডলেই বড়ো হয়েছেন তিনি। সিনেমা ও জীবনদর্শনের মূল ভিতটা ওখানেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাই যখন ‘মান্টো’ করার কথা ভাবলেন, তখন সঙ্গে সঙ্গেই শুরু করে দেননি সিনেমার কাজ। চারটি বছর স্রেফ গবেষণা করেছেন সাদাত হসন মান্টোর ওপর। তাঁকে জেনেছেন, চেষ্টা করেছেন ওই সময়ের ভেতরে পৌঁছতে। 

আর অভিনয়? একবার ভালো করে তাঁর সিনেযাত্রার দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে জঁরটা। মনে পড়ে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে মুক্তি পাওয়া দীপা মেহতার ‘ফায়ার’ সিনেমার কথা? দুজন মেয়ের সমকামী সম্পর্কের গল্প, জীবনের গল্প; এবং তাৎপর্যপূর্ণ হল, মেয়ে দুটির নাম সীতা আর রাধা। শাবানা আজমির পাশে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছিলেন নন্দিতা দাস। তারপর ‘১৯৪৭ আর্থ’, ‘হাজার চুরাশি কি মা’, ‘বাওয়ান্ডার’… গ্রাফ এগিয়েছে তরতরিয়ে। বাংলাতেও বারবার ফিরে এসেছেন নন্দিতা। সেখানে হাল ধরেছেন কখনও মৃণাল সেন, কখনও ঋতুপর্ণ ঘোষ। 

কিন্তু প্রতিটা ক্ষেত্রে উঠে এসেছে ভারতের সামাজিক ছবি। যে সমাজ দেশভাগে দীর্ণ, যেখানে প্রতিনিয়ত মেয়েদের লাঞ্ছিত হতে হয়, ধর্ষিতা হতে হয়। যেখানে সমকামী সম্পর্ককে বলা হয় ‘অপরাধ’। নিজের কাজের মাধ্যমেই নিজের কথাগুলো বলে দিতে চান নন্দিতা দাস। তাই নিজের প্রথম পরিচালিত ছবি ‘ফিরাক’-এর পটভূমি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন গুজরাটের দাঙ্গা। এমন একজন মানুষ যে মান্টোর কাছে যাবেন না, তা কি হয়! 

অবশ্য সিনেমার বাইরেও নন্দিতা দাসের আরও অনেকগুলো রূপ আছে। ঠিক যে প্রসঙ্গ ধরে লেখাটি শুরু হল, সেখানেই ফিরে আসা যাক। বর্ণবৈষম্য নিয়ে পৃথিবী জুড়ে আন্দোলনের ঝাঁঝ এখনও জারি আছে। কিন্তু জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু কি কোনো আকস্মিক ঘটনা? অন্তত ভারতের দিকে তাকালে এই কথাটা মেনে নেওয়া যায় না। মেনে নিতে পারেন না নন্দিতা দাসও। অন্যান্য ‘কালো মানুষদের’ মতো তাঁকেও শুনতে হয়েছে অনেক কথা। ভারতে আজও পরিস্থিতি বদলায়নি একচুলও। পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনে ‘ফর্সা, সুশ্রী’ মেয়েদের রমরমা। এই ব্যবস্থাটার বিরুদ্ধেই বহু বছর ধরে আন্দোলন করছেন নন্দিতা দাস। ‘ওম্যান অফ ওর্থ’-এর পক্ষ থেকে ২০০৯ সালে শুরু হয়েছিল ‘ডার্ক ইজ বিউটিফুল’ আন্দোলন। ২০১৩ সাল থেকে যার অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন নন্দিতা। শুধু মেয়ে নয়, লিঙ্গ-ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটা মানুষের হয়ে আওয়াজ তোলা শুরু করেন তিনি। 

আরও পড়ুন
বর্ণবৈষম্যের কারণে এখনও গ্রামে ‘একঘরে’ নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী-র পরিবার!

নন্দিতা দাস নিজে একজন সেলেব্রিটি, সিনেমা জগতের সঙ্গে যুক্ত। কাজ করতে এসেও এই বর্ণবৈষম্যের মুখে পড়েন তিনি। কিন্তু নিজের দক্ষতা মেধা, প্রতিভার ওপর আস্থা হারাননি। আর সেই মন্ত্রই আজ বিশ্বজুড়ে সবাইকে শোনাচ্ছেন নন্দিতা। ২০১৯ সাল থেকে নিজের উদ্যোগেই শুরু করেছেন আরও একটি ক্যাম্পেইন, ‘ইন্ডিয়া’স গট কালার’। তন্নিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায়, বিক্রান্ত মাসায়ে, রাধিকা আপ্টে, রত্না পাঠক-সহ সিনে ইন্ডাস্ট্রির একঝাঁক তারকাদের নিয়ে একটি মিউজিক ভিডিও তৈরি করেছিলেন তিনি। লক্ষ্য একটাই, পৃথিবী তো বটেই, ভারত থেকেও যেন এই ঘৃণ্য প্রথা দূরে চলে যাক… 

নন্দিতা দাস এখনও থামেননি। থামতে জানেন না। তিনি চরিত্রের মধ্যে গল্প খোঁজেন। সিনেমার মধ্যে ভারতের জীবনযাত্রার রূপ খোঁজেন। সত্যিটা যেন সত্যি হয়েই আমাদের সামনে ধরা দেয়। সেটা সিনেমায় যেমন, নিজের চিন্তাভাবনা, জীবনের আদর্শের সঙ্গেও তেমন। ফ্রান্সের সরকার ‘নাইট অফ দ্য অর্ডার অফ আর্টস অ্যান্ড লেটারস’ সম্মানে সম্মানিত করেছেন তাঁকে। ২০০৯ সালে ফ্রান্সে তাঁর নামে ডাকটিকিট স্ট্যাম্পও চালু করা হয়। এতসবের পরেও থামেননি নন্দিতা। ওই যে, থামতে যে জানেন না…           

তথ্যসূত্র-
১) ‘বাবার মধ্যে আমি মান্টোকে পেয়েছি’, প্রথম আলো
২) ‘India’s Got Colour: Nandita Das ‘reinvents’ her ‘Dark is Beautiful’ campaign’, NDTV
৩) ‘‘Fair & Lovely’ name change may seem superficial but it’s a step in the right direction’, Nandita Das, The Scroll

আরও পড়ুন
রুপোলি পর্দার বাইরেও তিনি সুপারহিরো; বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্য নাম ‘বোসম্যান’

Powered by Froala Editor

More From Author See More