রুপোলি পর্দার বাইরেও তিনি সুপারহিরো; বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্য নাম ‘বোসম্যান’

ক্ষত-বিক্ষত আহত সম্রাট টি’চালাকে এক ধাক্কায় খাদের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন কিলমঙ্গার। তারপর ডুয়ালের দর্শকদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “Is this your king?” চ্যাডউইক বোসম্যানের অভিনয় এবং ব্যক্তিত্ব যেন সেই ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ সিনেমার অগুনতি দর্শকদের থেকে কেড়ে নিয়েছিল উত্তরটা। হ্যাঁ, টি’চালাই তো সত্যি রাজা। যাঁর দক্ষ শাসন এক লুকিয়ে থাকা উপজাতিকে হাজির করেছিল বিশ্বের দরবারে। সিনেমার ফ্রেম, কাল্পনিক পটভূমি বাদ দিলে আজকের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এই চরিত্রে অভিনিত চ্যাডউইক বোসম্যানের ভূমিকাটাও যেন তাই-ই ছিল। বিশ্বের কাছে কৃষ্ণাঙ্গদের একটা জায়গা করে দিয়েছিলেন তিনি। ভেঙে দিয়েছিলেন বহু-প্রচলিত বর্ণ-বিদ্বেষের চিন্তাধারা। পরেছিলেন রাজমুকুট।

বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৩ বছর। অভিনয় কিংবা লেখালিখিতে ছেদ পড়েনি কোনো। সময় ফুরিয়ে আসছে জানতেন তিনি নিজেও। কয়েক বছর আগেই ধরা পড়েছিল মারণ রোগ। শুধু আরও কিছু সময় কিনে নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছিলেন লড়াইটা। নিজের লড়াই, ‘সমাজ’-এর চোখে ‘নিচু’ করে দেখা মানুষদের লড়াই। কেমোথেরাপির অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করেই সময় মেনে হাজির হচ্ছিলেন সিনেমার সেটে। কোলন ক্যানসারই রেশ টানল সেই যুদ্ধের। থেমে গেল হৃদস্পন্দন।

হাভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০০ সালে গ্র্যাজুয়েশন ফাইন আর্টসে। তারপর অভিনয়ের জগতে প্রবেশ। প্রথমে টেলিভিশন শো-তে অভিনয়। শুধু অভিনেতা এবং প্রোডিউসার হিসাবে পরিচিত হলেও বোসম্যান একজন স্বয়ং সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব। শুরুর দিনগুলোয় প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য অভিনয়ের পাশাপাশি স্ক্রিপ্ট রাইটিং এবং পরিচালনার মতো চেষ্টাও করে গেছেন। আদৌ কি ছেড়েছিলেন তিনি? কারণ মার্ভেলের ‘ওয়াকান্ডা’-র মতোই ব্যক্তিগত জীবনকেও লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন তিনি। ছিলেন একপ্রকার প্রচারবিমুখই। ২০১৯ সালে বিবাহের কথাও সংবাদ মাধ্যমের কাছে প্রকাশ করেননি তিনি। হয়তো নিজের জন্যই কেবল গুছিয়ে রেখে গেলেন তাঁর লেখাগুলোও।

হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার অনেক আগেই, স্কুলজীবনেই প্রথম নাটকে হাত দিয়েছিলেন বোসম্যান। ‘ক্রসরোড’-কে থিয়েটারে মঞ্চস্থ করা থেকে শুরু করে তার রচনা সবটাই করেছিলেন চ্যাডউইক বোসম্যান। ঢেলে দিয়েছিলেন নিঃশব্দ প্রতিবাদের আগুন। সহপাঠী এক কৃষ্ণাঙ্গ বন্ধুকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল তার মাসখানেক আগেই। 

বোসম্যান নিজেও বর্ণের জন্য সমস্যায় পড়েছেন বারবার। আর সেই সবটা অপমানের প্রতিবাদ প্রতিবার ঢেলে দিয়েছেন অভিনয়ে। টেলিভিশনের পর্দা থেকে সিলভার স্ক্রিনে সামিল হতেও তাঁকে মুখোমুখি হতে হয়েছে অনেক প্রতিবন্ধকতার। ২০০৮ সালে প্রথম ফিচার ফিল্মে সুযোগ পেলেন বোসম্যান। ‘দ্য এক্সপ্রেস’। তারপর আরও পাঁচ বছরের অপেক্ষা কোনো সিনেমায় মূল চরিত্রে অভিনয়ের জন্য। 

‘৪২’, ‘গেট অন আপ’ দুটি সিনেমার সুযোগ এসেছিল পর পর ২০১৩, ২০১৪-তে। ‘৪২’ ছবিতে প্রখ্যাত বাস্কেটবল খেলোয়াড় জ্যাকি রবিনসনের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বোসম্যান। আর ‘গেট অন আপ’ বায়োপিকে গায়ক জেমস ব্রাউনের চরিত্রে। দুই কৃষ্ণাঙ্গ তারকার চরিত্রে তাঁর অভিনয় পাল্টে দিয়েছিল অনেকের ধারণাই। এরপর ২০১৬ সালে ক্যাপটেন আমেরিকা সিভিল ওয়ারে প্রথমবারের জন্য ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’-এর চরিত্র অভিনয় করেছিলেন চ্যাডউইক বোসম্যান। বাকিটা ইতিহাস। এমন একটি চরিত্র যা ভেঙে দিয়েছিল এই বর্ণবৈষম্যের বেড়াজাল। “আমাদের কাছে রয়েছে এক অদ্ভুত বিশেষত্ব। যা বিশ্বের হাতে তুলে দিতে চাই আমরা। যা দিয়ে প্রকৃত মানুষের চরিত্র হয়ে উঠতে পারি আমরা। আমরা প্রত্যেকে যে পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি, সেই পৃথিবী গড়ে উঠতে পারে একমাত্র এভাবেই”। ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ ছবিতে ওয়াকান্ডার সম্রাট টি’চালা এভাবেই যেন সমাধানসূত্র দেখিয়ে দেন বৈষম্যের মতো সামাজিক সমস্যার। আহ্বান জানান সম্প্রীতির।

আরও পড়ুন
প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা নভশ্চর হিসেবে, স্পেস স্টেশনে যাচ্ছেন জেনেট এপস

কয়েকমাস আগেই জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু যেন আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিল সারা পৃথিবীতে। দেশ, রং ভুলেই মানুষ সামিল হয়েছিল ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’-এ। ২০২০-র এই ঘটনার বহু আগে থেকেই এই যুদ্ধ নীরবেই চালিয়ে যাচ্ছিলেন বোসম্যান। নিজের ট্যুইটার হ্যান্ডেলে বিখ্যাত প্রয়াত কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্বের ছবি তাঁদের জন্মদিনে পোস্ট করতেন বোসম্যান। কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব পাল্টে ফেলারই একটা প্রচেষ্টা। 

অভিনয় জগতে পুরস্কার কিংবা সম্মান প্রাপ্তির বিষয়টা না বললেও চলে বোসম্যানকে নিয়ে। তবে সারা পৃথিবীর সমস্ত বর্ণের মানুষের থেকে এই ভালবাসাটাও কি প্রাপ্তি নয়? সেখানেই যেন জিতে যান বোসম্যান। ৪৩ বছর বয়সে মাত্র কয়েকটা সিনেমা করেও অনুপ্রেরণা গেঁথে দেন হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গ যুবক-যুবতীদের মনে। বর্ণের বেড়া টপকে শুধু দক্ষতা দিয়ে চড়াই উতরানো যায় বুঝিয়েছিলেন বোসম্যান। যুগিয়েছিলেন অনেকের পায়ের নিচে ভরসার মাটি। ‘Get up general. Get up. This is no place to die. সিনেমার এই সংলাপ যেন সাধারণ অত্যাচারিত মানুষদের দিকেই ছুঁড়ে দিয়েছিলেন বোসম্যান। একজন সত্যিকারের রাজার মতোই। তাঁর এই আহ্বান গ্রহণ করে এগিয়ে এসেছিলেন ফুটবল তারকা থেকে শুরু করে অনেকেই। বুকের ওপর হাত রেখে ক্রস চিহ্ন যেন হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের নীরব সার্বজনীন ভাষা।

চ্যাডউইক বোসম্যানের অভিনয় করার আগেও মার্ভেল কমিক্সে ছিল ব্ল্যাক প্যান্থার। তাঁর এই নিঃশব্দ চলে যাওয়ার পরেও থাকবে। থাকবে মার্ভেলের সিনেম্যাটিক জগতে। হয়তো অন্য কেউ অভিনয় করবে সে চরিত্রে। তবে বারবারই ঘুরে দাঁড়ানোর যুদ্ধে ‘ওয়াকান্ডা ফরএভার’-এর মতোই প্রতিফলিত হবে ‘চ্যাডউইক বোসম্যান’ ফরএভার...

আরও পড়ুন
প্রয়াত 'ব্ল্যাক প্যান্থার' বোসম্যান,ক্যানসার কেড়ে নিল ৪৩ বছরের অভিনেতাকে

Powered by Froala Editor

More From Author See More