দেশের প্রথম মহিলা কার্ডিওলজিস্ট তিনিই, ১০৩ বছর বয়সে প্রয়াত ডাঃ পদ্মাবতী

তখন দেশ সদ্য স্বাধীনতা পেয়েছে। একটু একটু করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা। কার্ডিওলজি বা হৃদরোগ সংক্রান্ত শাস্ত্র তখনও একেবারেই অপরিচিত একটি ধারা। ভারতবর্ষকে এই জটিল চিকিৎসাব্যবস্থার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন যিনি, সেই ডা. এস. আই. পদ্মাবতী প্রয়াত হলেন রবিবার, ৩০ আগস্ট। করোনা ভাইরাস কেড়ে নিল আরেক কিংবদন্তিকে।

ভারতীয় হলেও, শিবারামাকৃষ্ণ আইয়ার পদ্মাবতী জন্মেছিলেন ব্রিটিশ শাসিত বার্মা প্রদেশে। সেটা ১৯১৭ সাল। বাবা-মা এবং তিন বোনকে নিয়ে তাঁদের পরিবার। বেশ সুখে স্বাচ্ছন্দ্যেই কেটেছে প্রথম জীবন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এসে সমস্ত লণ্ডভণ্ড করে দিল। বার্মা বা সিঙ্গাপুরে তখন ব্রিটিশ এবং জাপ বাহিনীর ক্রমাগত আক্রমণে বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষের জীবন। আর সেই কঠিন সময়ে বিরুদ্দেশ হলেন পদ্মাবতীর বাবা। তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। তিন বোন চলে এলেন ভারতের কোয়েম্বাটোরে। ১৯৪২, শুরু হল পদ্মাবতীর জীবনের লড়াই।

কোয়েম্বাটোরে বছর সাতেক কোনোরকমে সংসার পরিচালনার পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন পদ্মাবতী। এমবিবিএস পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন বার্মাতেই, রেঙ্গুন মেডিকেল কলেজ থেকে। কিন্তু ইচ্ছে ছিল এরপর স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনা করার। যুদ্ধের জটিলতায় সেটা সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়নি। ১৯৪৯ সালে পদ্মাবতী  রওয়ানা হলেন লন্ডনে। রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিশিয়ান অফ এডিনবার্গ থেকে পেলেন এফআরসিপিই সম্মান। এরপর ক্যুইন স্কয়ার মেডিক্যাল কলেজে প্রাথমিক প্র্যাকটিস, পরে মেরিল্যান্ডের জন হপকিন্স হসপিটাল, হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলে প্র্যাকটিস করলেন কিছুদিন। কিন্তু ভারতের মাটি যেন তাঁকে টানছিল। এদেশে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে যে অসংখ্য মানুষ বিনা-চিকিৎসায় মারা যান, তাঁদের দেখবে কে?

১৯৫৩ সালে ভারতে ফিরে এলেন ডা. পদ্মাবতী। যোগ দিলেন দিল্লির লেডি হার্ডিঞ্জ মেডিক্যাল কলেজে। সেখানে ১৯৫৪ সালে তৈরি হল কার্ডিওলজি বিভাগ। তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজকুমারী অমৃত কাউর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন পদ্মাবতীর দিকে। ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থায় শুরু হল নতুন একটি যুগ।

আরও পড়ুন
করোনা রোগীদের বিনামূল্যে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন শিলিগুড়ির প্রথম মহিলা টোটোচালক

ভারতে তখন হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র কার্ডিওলজিস্ট। তাঁদের মধ্যে তিনিই একমাত্র মহিলা। স্বাস্থ্য-শিক্ষাব্যবস্থায় এই বিষয়টি সদ্য পরিচিত। কিন্তু তার সুযোগ তখন ক্রমবর্ধমান। এমন অবস্থায় মেডিক্যাল কাউন্সিলের সদস্য হয়ে কার্ডিওলজি বিভাগে ডিএম ডিগ্রি চালু করার চেষ্টা শুরু করলেন ডা. পদ্মাবতী। পাশাপাশি এই সময় একাধিক গবেষণার কাজে যুক্ত হলেন তিনি। কর-পালমোনারি, হাইপেরটেনশনের মতো রোগের উপর প্রাথমিক স্তরের গবেষণা শুরু হয়েছিল তাঁরই উদ্যোগে। সারা জীবনে ৩০০টির বেশি গবেষণাপত্র লিখেছেন তিনি।

এর মধ্যে ১৯৬৭ সাল তাঁর জীবনে এক উল্লেখযোগ্য সময়। এই বছর পদ্মভূষণ পুরস্কার পেলেন তিনি। আর সেইসঙ্গে যোগ দিলেন মৌলানা আজাদ মেডিক্যাল কলেজে। এর পাশাপাশি শুরু হল দেশের সমস্ত কার্ডিওলজিস্টকে নিয়ে এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। ইতিমধ্যে ১৯৬২ সালে তৈরি হয়েছে অল ইন্ডিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন। তার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসাবে ছিলেন ডা. পদ্মাবতীও। ১৯৬৭ সাল থেকে সেই পরিষদের দায়িত্ব হাতে তুলে নিলেন ডা. পদ্মাবতী।

আরও পড়ুন
প্রয়াত বাংলাদেশের প্রথম মহিলা আলোকচিত্রী সাইদা খানম

সারা জীবনে চিকিৎসার সাধনার পাশাপাশি অনেক সম্মানও পেয়েছেন তিনি। ১৯৯২ সালে পেয়েছেন পদ্মবিভূষণ পুরস্কার। এছাড়াও দেশবিদেশের নানা সম্মানের মধ্য পেয়েছেন কার্ডিওলজিক্যাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে লাইফটাইম অ্যাওয়ার্ড (২০১২) এবং ন্যাশানাল অ্যাকাডেমি অফ মেডিক্যাল সায়েন্সের তরফ থেকে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড (২০১৩)। আর যা পেয়েছেন, তা হল অসংখ্য রোগীর ভালোবাসা। তাঁর হাতেই তো মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরত এসেছেন তাঁরা।

দেশের অসংখ্য মানুষের হৃদয়ের রোগ সারিয়ে তোলার কাণ্ডারি যে চিকিৎসক, তাঁর নিজের হৃদযন্ত্র কিন্তু করোনা ভাইরাসের আক্রমণ সহ্য করতে পারল না। বয়স তো হয়েছিলই ১০৩ বছর। সংক্রমণ ধরা পড়ার পর ভর্তি ছিলেন দিল্লির ন্যাশানাল হার্ট ইনস্টিটিউটে। শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকদের অসংখ্য প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। রবিবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। কার্ডিওলজির এই কিংবদন্তির মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ চিকিৎসক সমাজ।

আরও পড়ুন
ডাক্তারি পড়তে সুদূর মাদ্রাজে পাড়ি, দেশের প্রথম মহিলা ডাক্তার হতে পারতেন অবলা বসুই

Powered by Froala Editor

More From Author See More