“দিল্লিতে যখন কৃষকরা আন্দোলন শুরু করলেন, তখন মনে হল কৃষিবিলের সমস্যা এবং আন্দোলনকারী কৃষকদের দাবি বাংলার কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সেই চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝলাম, বাংলার আজকের কৃষির অবস্থা, কৃষকদের প্রতিদিনের বাস্তব সম্পর্কে কিছুই আমি জানি না। সেই জানার চেষ্টা থেকে, সেই খোঁজ থেকেই এই পত্রিকার কথা ভাবা।” বলছিলেন ‘আমাদের চাষের কাগজ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সাহিত্যিক ও পরিবেশকর্মী জয়া মিত্র। পত্রিকার উদ্দেশ্য সম্মন্ধে তিনি জানালেন। “কৃষকরা এখানে ‘আমাদের নিজেদের চাষ’ বিষয়ে তাঁদের নিজেদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কথা, আমাদের কৃষিসংস্কৃতির কথা বলবেন। আর আমরা নাগরিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষরা আমাদের সামান্য জানা তাঁদের সঙ্গে ভাগ করে নেব। উদ্দেশ্য এটুকুই।”
উত্তাল সত্তরের সময় মাও সে তুঙ-এর ভাবনায় উদবুদ্ধ হয়ে জন্ম নিয়েছিল গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার তত্ত্ব। কৃষির সঙ্গে, কৃষকদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল রাজনৈতিক অনুসঙ্গ। সেই পথের সঙ্গে ‘আমাদের চাষের কাগজ’-এর পথ আলাদা বলেও মনে করেন না তিনি। তাঁর বক্তব্য, ‘২৪ বছর বয়সে আমি যে রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করতাম, তার একটা মূল বিষয় আমি আজও বিশ্বাস করি। সাধারণ খাটিয়ে মানুষদের পাশে থাকা ছাড়া আমাদের শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত মানুষদের আর কোনো কাজ নেই। বাকি সব বাহুল্য। আমি আঠেরো বছর বয়সেও নিজের দেশকে চিনতে, বুঝতে চেয়েছিলাম। আজও তাইই চাই। যতো চলছি সামনে নতুন নতুন চিন্তাপথ খুলে যাচ্ছে’। তবে চিন্তাকে ভিন্নভিন্ন জল-অচল খোপে ভাগ করে ফেলাতেও বিশ্বাস করেন না তিনি। “কোনো মানুষ যেমন সারাজীবন একতা ঘরে বাস করে না, সেরকমই সচেতন চিন্তাশীল একজন লোক সারাজীবন একই চিন্তা করে যেতে পারেন না। তার অভিজ্ঞতা, বোঝা চিন্তার মধ্যে বারে বারে পরিবর্তন নিয়ে আসে। আবার কোথায় একটা চিন্তা শেষ হয়ে আরেকটা চিন্তা শুরু হয় সেটাও কোন জ্যামিতিক বিন্দু দিয়ে হিসেব করা যায় না।”
এই পরিবর্তনও যেন একটা শিক্ষারই অঙ্গ। জয়া মিত্র বলছেন, “১৯৭৪ সালে জেল থেকে ফিরবার পর যখন পার্টির নেতৃত্ববাদী চেহারাটা দেখলাম, তখন বুঝলাম ক্ষমতা আর সাম্যভাবনা কখনো একসঙ্গে থাকতে পারে না। পাঁচদশক পর আজ ইতিহাসের সেই শিক্ষার প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে যখন সারাদুনিয়ায় আজকের আন্দোলনগুলোতে কোন রাজনৈতিক পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রয়োজনই পড়ছে না। যে কোন ছোট ঘটনা বা একজন মানুষের প্রতিবাদও অনেক বড় আয়তন পেতে পারে। অকুপাই মুভমেন্ট শুরু হয়েছিল সামান্য একটি ব্রিজ পার হতে পুলিশী বাধার প্রতিবাদে। গ্রেটা থুনবার্গের মত কিশোর কিশোরিদের স্কুল না যাওয়াও পরিবেশ রাজনীতির স্বপক্ষে এক বিরাট প্রতিরোধ হয়ে দাঁড়ায়। একই কথা আজ দিল্লির কৃষক অবস্থান সম্পকে সত্য। শ্রমিকদের (সর্ব অধিকার হরণ) আইন, পরিবেশ (ধ্বংসমূলক) আইনের মতই কৃষি আইনও বিনাবাধায় পাস হয়ে যেত যদি এই বিপুল সংখ্যায় কৃষকরা এতখানি বড় করে কেন্দ্রীয় সরকারের আইনের এরকম বিরোধিতা না করতেন। বহু ছোট প্রতিবাদের নিজস্ব স্বরকেও ঘিরে আন্দোলন দানা বাঁধছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে সারা পৃথিবিতে দক্ষিণপন্থীদের ক্ষমতা যেমন শাসনক্ষমতায় কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, প্রতিরোধের স্বরও ততই বি-কেন্দ্রীভূত হয়ে যাচ্ছে। এ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।”
তবে আজও প্রকৃতি ও মানবসভ্যতার অনেক বুনিয়াদী সম্পর্কের কথা শিক্ষিত মানুষের চর্চা বা জ্ঞানের বাইরেই রয়ে যাচ্ছে। সেই বিচ্ছিন্নতাকে পার করা, নিজেদের সভ্যতা সংস্কৃতির ভিত্তি যে কৃষি সেই জ্ঞানকে স্পষ্ট করে তোলার একতিল চেষ্টা করার জন্যই ‘আমাদের চাষের কাগজ’-এর উদ্যোগ নেওয়া। “সবুজ বিপ্লবের শিকার পাঞ্জাব-হরিয়ানার কৃষকরা তাঁদের ক্ষত সারিয়ে তুলতে জোট বেঁধেছেন। সবুজ বিপ্লবের আরেক শিকার বাংলা। ‘আমাদের চাষের কাগজ’ যদি সেইসব স্বরকে এক জায়গায় তুলে আনতে পারে, তাহলে তার থেকে আনন্দের আর কিছুই হবে না।” বলছিলেন জয়া মিত্র।
আরও পড়ুন
কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে ‘বেলা চাও’-এর পাঞ্জাবি অনুবাদ, সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল ভিডিও
ক্রমশ পত্রিকার চাহিদা বাড়ছে বলেও জানালেন তিনি। প্রথম মাসে মাত্র ৬০০ কপি প্রকাশ করে ভেবেছিলেন সব কপি লাগবে না। কিন্তু পরের সংখ্যায় ছাপতে হল ১৫০০ কপি। আগামী মাসে হয়তো আরও বেশি সংখ্যায় প্রকাশিত হবে ‘আমাদের চাষের কাগজ’। জয়া মিত্রের কথায় একটা দায়িত্বের কথা উঠে আসে বারবার, “এই উদ্যোগ তো রাজনৈতিক দলগুলোরই নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাঁদের কাছ থেকে এই প্রত্যাশা মানুষ আর করে না। ভয় পাচ্ছিলাম এই চেষ্টায় হাত দিতে। এতবড় কাজ, এ কী আমাদের মত সামান্য মানুষের সাধ্য! কিন্তু কাউকে না-কাউকে তো শুরু করতেই হবে। খুব অস্থির হচ্ছিল মন। বারে বারে মনে হচ্ছিল, সেই শুরুটা কে উপযুক্ত বড়ো করে করতে এগিয়ে আসবেন, সে জন্য বসে অপেক্ষা না-করে তুমি করছনা কেন? অন্তত জল ছিটিয়ে উঠোন ঝাঁট দেবার কাজটুকু তো সেরে রাখতে তো পারো! তারপর উপযুক্ত যোগ্যতার কেউ না কেউ এসে দায়িত্ব নেবেন। সেটুকুই সাধ্যমত চেষ্টা করছি।”
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন, সরকারি পদক ও সম্মাননা ফেরাচ্ছেন ১৫০ ক্রীড়াবিদ