উত্তরাখণ্ডের নিঃসঙ্গতম বাসিন্দা ‘উমথেরের দাদি’

পাহাড়ের বুকে ছোট্ট একটা গ্রাম। ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে গুটিকয়েক বাড়ি। তবে মানুষের নাম-গন্ধ না থাকায়, সেসব বাড়ির অবস্থা শোচনীয়ই বটে। ফলে, গোটা অঞ্চলটার দখল নিয়েছে চিতাবাঘ কিংবা অজগর সাপ। বাড়ির উঠোন, রাস্তা— সর্বত্রই অবাধ বিচরণ তাদের। এমনই একটা ভয়ঙ্কর জায়গায় যদি একা সপ্তাহখানেক থাকতে বলা হয় আপনাকে? 

খুব স্বাভাবিকভাবেই উত্তর আসবে ‘না’। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এই গ্রামে এইসব ভয়াল প্রাণিদের মধ্যেই একাকী বসবাস করেন এক বৃদ্ধা মহিলা। বুন্দি দেবী (Bundi Devi)। উত্তরাখণ্ডের উমথেরে গ্রামের এই মহিলা স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ‘উমথেরের দাদি’ কিংবা ‘উত্তরাখণ্ডের নিঃসঙ্গতম ব্যক্তি’ হিসাবেই। আজ নয়, দীর্ঘ কয়েক দশক এভাবেই দিনযাপন করছেন তিনি। 

অবশ্য আজ থেকে পাঁচ-ছ’দশক আগেও এই অবস্থা ছিল না গ্রামের। সেখানে বসবাস করত গোটা ছয়-সাতেক পরিবার। দুই সন্তান, স্বামী নিয়ে বুন্দি দেবীরও তখন ভরা সংসার। আজ থেকে ৫০ বছর আগে প্রয়াত হন তাঁর স্বামী। একাই দুই পুত্রসন্তানকে বড়ো করেছেন তিনি। শিখিয়েছেন পড়াশোনা। কিন্তু এই প্রত্যন্ত গ্রামে চাকরি কোথায়? কাজেই উত্তরাখণ্ডের অন্যত্র পাড়ি দিতে হয়েছে তাঁদের। জীবিকার অনুসন্ধানে একে একে গ্রাম ছেড়েছেন বাকিরাও। শুধু একলা থেকে গেছেন বুন্দি দেবী। স্বামীর ভিটে ছেড়ে যেতে নারাজ তিনি। 

তিন কামরার বাড়ি হলেও, একটি মাত্র ঘরই এখন বাসযোগ্য রয়েছে তাঁর বাড়িতে। সেটার অবস্থাও বেশ শোচনীয়। বাড়ি সারানোর লোক-জন পাওয়াই যে দুষ্কর। কোনোমতে প্লাস্টিক দিয়ে ছাদের ফাটল ঢেকে রেখেছেন বুন্দি দেবী। বাড়ি থেকে বেরোবারও জো নেই। পাছে হিংস্র জানোয়ারের খপ্পরে পড়তে হয়। অবশ্য সপ্তাহে দু-একবার শুধু জল সংগ্রহের জন্য বেরতেই হয় তাঁকে। বাকি সমস্ত সময়টাই গৃহবন্দি। ঠিক যেন আজীবনের কোয়ারেন্টাইন। আর খাওয়া-দাওয়া? 

মাস তিনেক ছাড়া ছাড়া তাঁর দুই সন্তান এসে মুদিখানার সামগ্রী, শুকনো খাবার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দিয়ে যান তাঁর কাছে। সেটা দিয়েই চলে গোটা মাস। কখনও সঞ্চয় ফুরিয়ে এলে পাশের গ্রামে গিয়ে ফোন করেন সন্তানকে। নিজের বাড়িতে ফোন, ইন্টারনেট, টেলিভিশন, এমনকি ঘড়িও নেই তাঁর। দিনের বেলা গাছের ছায়া, আর রাতের সময় নক্ষত্র— এই তাঁর সময় নির্ণয়ের হাতিয়ার। 

তবে শুধু উমথেরে নয়। গোটা উত্তরাখণ্ড জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এমন অসংখ্য ঘোস্ট ভিলেজ বা পরিত্যক্ত জনপদ। যার সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। পরিসংখ্যান বলছে, উত্তরাখণ্ডে সব মিলিয়ে ১৫৬৪টি এই ধরনের গ্রাম রয়েছে, অভিবাসী হয়েছেন যেখানকার ৫০ শতাংশ মানুষ। তবে বুন্দি দেবীর মতো নিঃসঙ্গ ব্যক্তির উদাহরণ গোটা রাজ্যে আর নেই বললেই চলে। 

বছর কয়েক আগে উমথেরেরই কয়েক মাইল দূরে পর্যটন শিল্প গড়ে তোলার প্রকল্প নেয় উত্তরাখণ্ড সরকার। ঘোষিত হয়েছিল ৬০ কোটি টাকার বাজেট। কিন্তু এখনও বাস্তবায়ন শুরু হয়নি সেই প্রকল্পের। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিমত, এই মোটা অঙ্কের বাজেটের ১০-১৫ শতাংশ গ্রামের উন্নয়ন এবং রাস্তা তৈরিতে খরচ করলে হয়তো ঠেকানো যেতে পারত গণ-অভিবাসন। কিন্তু প্রান্তিক মানুষগুলোর এই অসহায়তার কথা আদৌ কি নজর কাড়বে সেখানকার সরকারের? 

Powered by Froala Editor