সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে ষড়যন্ত্রের শিকার, বহিষ্কৃত সুরেন্দ্রনাথই হয়ে উঠলেন ‘রাষ্ট্রগুরু’

‘গুরু’ তিনিই, যিনি সত্যের প্রকৃত অর্থ অনুভব করে ছড়িয়ে দিতে পারেন অনুগামীদের মধ্যে। শুধু পুঁথিগত শিক্ষা নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যিনি নবচেতনার স্বাদ নিয়ে আসেন, তাঁকেই দেওয়া যেতে পারে ‘গুরু’-র আসন। স্বাধীনতাপূর্ব ভারতে শিল্প-সাহিত্য-সমাজ-রাজনীতিতে আবির্ভাব হয়েছিল এরকম কয়েকজন গুরুর। যাঁরা পথনির্মাণ করেছিলেন দেশের বিকাশের জন্য। ‘রাষ্ট্রগুরু’ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (Surendranath Banerjee) ছিলেন যাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। আইসিএস-এর মতো কঠিন পরীক্ষায় পাশ করে ইংরেজ সরকারের সেবায় কেটে যেতে পারত জীবন। কিন্তু, ঔপনিবেশিক সময়ের ভারতের ইতিহাস লিখিত হচ্ছিল আপন ছন্দে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কেও দিতে হল ভারতীয় হওয়ার মাশুল। 

১৮৬৩ সালে প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস বা আইসিএস পরীক্ষায় পাশ করেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সুরেন্দ্রনাথ কৃতকার্য হন ১৮৭১ সালে। ২২ নভেম্বর সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্ত হলেন, কর্মক্ষেত্র শ্রীহট্ট। জেলাশাসকের পদে ছিলেন মি. সাদারল্যান্ড। তাঁর কাছে থেকে কাজ শিখবেন সুরেন্দ্রনাথ। কলকাতা থেকে সাত দিনের পথ পার করে পৌঁছোলেন নতুন স্থানে। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই চাকরি গেল তাঁর। কেন? বিপিনচন্দ্র পাল লিখছেন, “সুরেন্দ্রনাথ শ্রীহট্টে ইংরাজের কেবল অনুকরণ করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন না, ইংরাজ সিভিলিয়ানদের সঙ্গে সকল বিষয়ে আপনাকে সমান আসনে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহিয়াছিলেন। বিজিত বাঙালির এই স্পর্ধা বিজেতা ইংরাজ রাজপুরষের অসহ্য হইয়া উঠিল।” অন্যদিকে দেশীয় সহকর্মীদেরও খুব একটা পাত্তা দিতেন না তিনি। ফলে তারাও একপ্রকার শত্রু হয়ে উঠল। যেই মুহূর্তে সুযোগ পেল, দু’পক্ষই আক্রমণ করল সুরেন্দ্রনাথকে।

প্রথম দিকে সাদারল্যান্ড সন্তুষ্টই ছিলেন তরুণ যুবকের কাজে। যদিও শ্রীহট্টের শ্বেতাঙ্গ আমলারা সুরেন্দ্রনাথের আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় ক্রমশ হয়ে উঠছিলেন ক্ষিপ্ত। এর মধ্যে দেখা গেল তাঁর স্ত্রী চণ্ডী দেবী মেমদের মতো পোশাক পরে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন শহরের রাস্তায়। সঙ্গে সুরেন্দ্রনাথ। একদিন দাবি তুললেন রেসের মাঠে মেমদের গ্যালারিতে বসার। স্বামীর পদমর্যাদা অনুযায়ী এই সম্মান তাঁর অবশ্যই প্রাপ্য। রেসের মাঠে বসাটা অবশ্য তুচ্ছ ব্যাপার, আসল হল অধিকার অর্জন। স্বাভাবিকভাবেই, শ্রীহট্টের সাহেবরা প্রতিপদে আপত্তি তুলতে লাগলেন তাঁর কাজকর্ম নিয়ে। সেখানকার ভারতীয় কর্তাব্যক্তিরাও ভালো চোখে দেখেননি বিষয়টিকে। স্বজাতির কেউ শিক্ষা ও কাজের গুণে রাজন্যবর্গের সমান হয়ে উঠবেন, এই ভাবনা থেকে জন্ম হল ঈর্ষার। সাদারল্যান্ডেরও নজর এড়িয়ে যায়নি ব্যাপারটি। সহকারী ম্যাজিস্ট্রেটের আচার-আচরণের সমস্ত খুঁটিনাটি থাকত তাঁর কাছে। ফলে উভয়পক্ষই যে সুরেন্দ্রনাথের উপর ক্ষুব্ধ, সেটিকে অবহেলা করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না।

অবশেষে একটি নৌকাচুরির ঘটনা একদিন বিরাট আকার ধারণ করল। যুধিষ্ঠির নামের এক ব্যক্তিকে প্রথমে অভিযুক্ত সাব্যস্ত করা হলেও, পরে প্রমাণাভাবে নির্দোষ সাব্যস্ত করতে হয় তাকে। শাস্তি হয় অন্য একজনের। যদিও মোকদ্দমার নথিতে আসামী হিসেবে রয়ে গেল যুধিষ্ঠিরের নাম। হাকিমের সই-সহ মামলাটি ‘ক্লোজড’ও হয়ে যায়। কিন্তু এক নির্দোষ ব্যক্তির নামে ওয়ারেন্ট জারি হয়ে থাকার কারণে অভিযোগ ওঠে সহকারী ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে। কীভাবে এত বড়ো ‘ভুল’ চোখের আড়ালে রয়ে গেল? অথচ দায় সেক্ষেত্রে হাকিম ও পেশকার উভয়েরই। কিন্তু পারিপার্শ্বিক বাতাবরণের জন্য সমস্ত দোষ গিয়ে পড়ে সুরেন্দ্রনাথের উপর। এই ‘অসাবধানতার’ জন্য জজসাহেব রায় দেন, “এ অবস্থায় তাঁর হাতে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা আর থাকা বিধেয় নয়।”

আরও পড়ুন
স্বাধীনতার পর, সরকারের দেওয়া পেনশন নিতেও অস্বীকার করেন বীণা

লঘু পাপে গুরু দণ্ড হল তাঁর। কিছুদিনের জন্য নিম্নতর ম্যাজিস্ট্রেটের কাজে রাখলেই কিন্তু অনায়াসে সমস্যার সমাধান করা যেত। তার বদলে রীতিমতো কমিশন বসানো হল বিচারের জন্য। সরকারি ব্যয়ে একজন কৌঁসুলি নিয়োগের আবেদন জানিয়েছিলেন সুরেন্দ্রনাথ। তাও অগ্রাহ্য হয়। প্রথমে ভেবেছিলেন উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্বপক্ষের আইনজীবী হিসেবে নিযুক্ত করবেন। কিন্তু ভারতীয়দের বিরুদ্ধে যে বিরোধিতার রূপ তিনি দেখেছিলেন, তাতে আর কোনো ভরসা রইল না। শেষ পর্যন্ত মিঃ মন্ট্রি নামক এক শ্বেতাঙ্গকেই নিযুক্ত করেন তিনি। অবশ্য তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। কমিশন তাঁকে দোষী সাব্যস্থ করে এবং সেই সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে তাঁকে সিভিল সার্ভিস থেকে বহিষ্কার করা হয়। 

আরও পড়ুন
দেশের জন্য লড়েও ছাড়তে হয়েছিল ভিটে, দিনাজপুরের ‘অবজ্ঞাত’ স্বাধীনতা সংগ্রামীর গল্প

আরো কিছু কারণও লুকিয়ে ছিল ফল্গুধারার মতো। যা সুরেন্দ্রনাথের চাকরিজীবনকে ঠেলে দিয়েছিল অনিশ্চয়তার দিকে। অনেকে বলতেন, কর্মক্ষেত্র থেকে বহিষ্কারের জন্যই তিনি ইংরেজ বিরোধিতার প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এই যুক্তিকে মান্যতা দিলেও ক্ষতি নেই। কারণ, তাতে শেষ পর্যন্ত লাভ হয়েছিল এদেশের রাজনৈতিক পটভূমিরই। পেয়েছিল ‘রাষ্ট্রগুরু’-কে। এক অর্থে তাঁর জীবন, একটি বিশেষ যুগের ভারতের রাজনৈতিক পরিবেশের ইতিহাস। 

Powered by Froala Editor